আরব কূটনীতিকদের জন্য মে মাসটি খুবই ব্যস্ত সময় ছিল। আরব লিগ থেকে সিরিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার ১২ বছর পর এ মাসেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে আবার সংগঠনটিতে স্বাগত জানানো হয়েছে।
একই সময়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যেও মিলমিশের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও ইসলামিক জিহাদের মধ্যে মিসর মধ্যস্থতা করছে এবং সুদানের গৃহযুদ্ধ অবসানে সৌদি আরব প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
এসব জায়গায় পশ্চিমের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এটি ঠিক যে গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের সম্পৃক্ততার পারদ ওঠানামা করেছে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ইসরায়েল ও জর্ডানের মধ্যে শান্তি স্থাপন, ইসরায়েলের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এবং ২০১৫ সালের ইরান চুক্তিসহ এই অঞ্চলের বেশির ভাগ বিষয়ের কূটনৈতিক অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে শুধু কিছু মার্কিন সেনার উপস্থিতি আছে—ইরাক ও সিরিয়ায়।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার এই সরে আসাটা চীনের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে মনোযোগ বাড়ানোর ছকের অংশ বলে মনে হচ্ছে। একজন সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, এটি আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে শুধু নাইন ইলেভেন-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া নয়, বরং তারা ১৯৯০–এর দশকের আগেকার নীতিতে ফিরতে চায়। ওই সময় উপসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে আঞ্চলিক মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল থেকে যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যূনতম সামরিক উপস্থিতি রেখেছিল।
জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের আটকাবস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর প্রশাসনের সামর্থ্য নিয়ে সগর্ব পুলক বোধ করেন। কারণ, তাঁর দুই পূর্বসূরি বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এশিয়ার দিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি।
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতা বুঝতে গেলে প্রথমত উপসাগরীয় অঞ্চলের মাঠের বাস্তবিক অবস্থা এবং পশ্চিমাদের চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে পিষ্ট হয়ে গোটা এলাকা যে দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে, সে বিষয়ে সহমর্মী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ এখনো দুই রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বকে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও মাঠের অবস্থা হলো, এই তত্ত্ব থেকে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়েই অনেক দূরে সরে গেছে।
যেহেতু ইসরায়েলের ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠরা আগের চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী ও অতি-গোঁড়া হয়ে উঠেছে, সেহেতু বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি নাগরিক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধকে সমর্থন করছে।
এদিকে, ইরানের দ্রুত অগ্রসরমাণ পারমাণবিক কর্মসূচি মোকাবিলায় পশ্চিম কূটনৈতিক গুরুত্বের কথা বলে চললেও এই ক্ষেত্রে সামান্যই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ দমনে ইরান সরকার যে ব্যাপক দমন–পীড়ন চালিয়েছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান যেভাবে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য আমেরিকান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করা যেতে পারে।
পশ্চিমের দৃষ্টি সরে যাওয়ায় পারমাণবিক কর্মসূচিও এগিয়ে নিচ্ছে ইরান। পশ্চিম মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করতে অন্য দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গাজায় ইসরায়েল ও ইসলামিক জিহাদের মধ্যে হামলার ঘটনায় মধ্যস্থতা করতে পশ্চিমারা নয়, বরং মিসর এগিয়ে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন উপস্থিতি সরে গেলে এই অঞ্চল বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হতে পারে বলে অনেকে প্রথম দিকে মনে করেছিলেন, কিন্তু আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়া করে পশ্চিমের পাততাড়ি গোটানো দেখে এখন তাঁরা পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বা পশ্চিমা উপস্থিতিকে যেকোনো জায়গার অস্থিতিশীলতার কারণ বলে মনে করেন।
রাশিয়া ও চীনের মতো বহিরাগত শক্তির নেতৃত্বাধীন এই নতুন মধ্যপ্রাচ্যব্যবস্থা নিজের স্বৈরাচারী শাসনের ভূমিকার কারণে পশ্চিমা চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে একমত না–ও হতে পারে। যদিও পশ্চিম ভেবেছিল, তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে গেলে সেখানে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে; কিন্তু এটি অনস্বীকার্য যে তারা সরে আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা কমে এসেছে। ইয়েমেনে সহিংসতা কমে আসা, চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরানের সমঝোতা এবং মোহাম্মাদ বিন সালমানের রাজনৈতিক পরিপক্বতা সে বিষয়টিকেই প্রতিফলিত করে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই উদীয়মান নতুন ব্যবস্থাকে একটি কর্তৃত্ববাদী শান্তিবলয় হিসেবে মনে করা যেতে পারে। তারা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখে রয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে অঞ্চলটি এখন অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেছে যে বিষয়গুলোর বদলে এর আগে পশ্চিমারা অন্যদিকে গুরুত্ব দিয়েছিল বলে মনে হয়। সূত্র: প্রথম আলো।
এসডব্লিউএসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ