ভারতবর্ষে কফির আগমন হয়েছিল ব্যবসায়ী ও সুফিদের হাত ধরে, সেই ১৬ শতকে। মোগল দরবারের অনেক অভিজাত সদস্য কফি পান করতেন। ১৬ শতকের পর থেকে পশ্চিমা ইসলামি সাম্রাজ্য যেমন দামেস্ক, আলেপ্পো, কায়রো এবং ইস্তাম্বুলের মতো ভারতেও ক্যাফে সংস্কৃতি চালু হয়। কিন্তু ব্রিটিশেরা এ অঞ্চলে এসে কফির বদলে চা-কে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে শুরু করে।
১৫ শতকের কোনো এক সময় হর্ন অব আফ্রিকা (ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতি ও সোমালিয়া) থেকে ইয়েমেনে কফি বাজারজাত হয়। এরপর তা উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আর ইউরোপে কফির প্রচলন হয় ১৬ শতকে।
এক পর্যায়ের কফির খ্যাতি পূর্বাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতের মোগল সম্রাট ও তাদের শীর্ষ কর্তাদের পছন্দের পানীয়র তালিকায় যুক্ত হয় এটি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের ঝোঁক ছিল ওয়াইনের প্রতি। আর তার দরবারের হিন্দু কিংবা মুসলিম অভিজাতেরা আসক্ত হন কফির প্রতি।
জাহাঙ্গীরের দরবারের ইংরেজ দূতাবাসের ধর্মযাজক এডওয়ার্ড টেরি বলেন, দরবারের সদস্যরা কফির গুণমুগ্ধ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, কফি ‘আত্মার শক্তি বাড়ায়, হজমে সহায়তা ও রক্ত পরিশুদ্ধ করে।’
উপমহাদেশে আরব এবং তুরস্কের ব্যবসায়ীরা কফির বীজ নিয়ে আসেন। মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।
শুধু কফিই নয়, ব্যবসায়ীরা মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ইরান ও তুরস্ক থেকে সিল্ক, তামাক, তুলা, বিভিন্ন মসলা ও রত্নপাথরসহ আরও অনেক কিছু ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়ে আসেন।
জাহাঙ্গীরের ছেলে শাহজাহানের রাজত্বকালে (১৬২৮-১৬৫৮) এসব পণ্য বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সমাজের কফির প্রতি ভালোবাসাও বাড়তে থাকে। এটাকে স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে মনে করা হতো। দিল্লির অভিজাতদের সামাজিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও হয়ে ওঠে কফি।
তখনকার ইউরোপিয়ান পর্যটক জোয়ান আলব্রেখত ডি ম্যান্ডেলসো বলেন, মনে করা হতো, গরম কমিয়ে শরীর ঠান্ডা রাখে কফি।
ধর্মীয় প্রথা পালনকালেও কফির ব্যবহার হতো। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার মতো ভারতের সুফিরাও রাতব্যাপী জিকিরের আগে কফি পান করতেন।
জানা যায়, বাবা বুধন নামক এক সুফি সাধক ১৬৭০ সালে মক্কা থেকে ফেরার সময় সাতটি কফি বীজ নিয়ে আসেন। সেগুলো রোপন করেন চিকমাগালুর নামক এক জায়গায়।
এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা না গেলেও কর্নাটকে তার নামে পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। কফি উৎপাদনে এ জায়গাটি বিখ্যাত।
ভারতীয় কফি বোর্ডের তথ্যমতে, ইয়েমেনের মোখায় ভ্রমণে যাওয়া সুফি সাধকরাও কিছু কফি বীজ নিয়ে ফিরেছিলেন।
১৬ শতকের পর থেকে পশ্চিমা ইসলামি সাম্রাজ্য যেমন দামেস্ক, আলেপ্পো, কায়রো এবং ইস্তাম্বুলের মতো ভারতেও ক্যাফে সংস্কৃতি চালু হয়। পুরোনো দিল্লিতে কাওয়াখানা তথা আধুনিক কফি হাউসের সন্ধান পাওয়া যায়।
খাদ্য ইতিহাস নিয়ে কাজ করা নেহা ভারমানি তার স্পিলিং দ্য বিনস: দ্য ইসলামিক হিস্টোরি অব কফি-তে মোগল আমলের কফি হাউস ‘আরব সরাই’-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
১৫৬০ সালে আরব সরাই স্থাপন করেন মোগল সম্রাট হুমায়ূনের বিধবা স্ত্রী হামিদা বানু। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে এখনো হুমায়ূনের সমাধিতে বিদ্যমান।
ইতিহাসবিদ স্টিফেন ব্ল্যাক তার শাহজাহানাবাদ: দ্য সভেরেইন সিটি ইন মোগল ইন্ডিয়া ১৬৩৯-১৭৩৯ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, কফি হাউস ছিল এমন জায়গা যেখানে কবি, গল্পকথক, সুবক্তা ও আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান এমন লোকজন জড়ো হতেন ।
কফি হাউসগুলোতে কবিতা আবৃতি হতো, গল্প বলা হতো কিংবা বিতর্ক হতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বোর্ড গেইম খেলা হতো। আর এসব কর্মকাণ্ড কীভাবে শহরের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলত তাও তুলে ধরেন স্টিফেন।
ইসফাহান এবং ইস্তাম্বুলের মতো শাহজানাবাদের কফি হাউসগুলো একটি সমৃদ্ধ খাদ্য সংস্কৃতির উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। এ খাদ্য সংস্কৃতি এখনো পুরো দিল্লিতে প্রচলিত।
১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসনে ছিলেন নবাব আলীবর্দী খান। তার জীবনে কফি এবং খাদ্য ছিল সবচেয়ে প্রশান্তির জিনিস। সে সময়ের ইতিহাসবিদ সাইদ গোলাম হুসেইন খান তার শেইর মোতাখেরিন গ্রন্থে আলীবর্দী খানের প্রতিদিনকার কার্যাবলির এক চমকপ্রদ বিবরণ দেন।
তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (নবাব) সবসময় সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা আগে উঠতেন; ফজরের নামাজের পর তিনি ঐশ্বরিক আদেশের প্রার্থনা করতেন এবং তারপর পছন্দের বন্ধুদের সাথে কফি পান করতেন।
‘এরপর তিনি পুরো এক ঘণ্টা বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে, তেলাওয়াত শুনে, কবিতা পড়ে বা কিছু আনন্দদায়ক গল্প শুনে সময় কাটাতেন।’
সকালের নাস্তা নবাব তার ব্যক্তিগত বাবুর্চির প্রস্তুত করা ইরানি খাবার দিয়ে করতেন। গোলাম হোসেন খানের বর্ণনায় নবাবকে একজন চমৎকার রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। যিনি দরবারী জীবনের বিলাসিতাকে কার্যকর শাসনের মতোই মূল্য দিতেন।
আলীবর্দী খান তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য থেকে সবচেয়ে ভালো মানের কফি আমদানি করে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন।
দরবারের জন্য সেরাটা বাছাই করতেন তিনি। বিভিন্ন অঞ্চলের খাবার রান্নার জন্য ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া থেকেও বাবুর্চি নিয়ে আসা হতো। দরবারে গল্পকথক, চিত্রশিল্পী, কফি প্রস্তুতকারক এবং চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
আলীবর্দী খানের নিয়োগ দেওয়া লোক কফি তৈরির জন্য বিশেষ যন্ত্রও সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।
তবে ভারতে কফির প্রচলন এরপর বেশিদিন ছিল না। নবাব সিরাজউদ্দৌলা আলীবর্দী খানের মতো রাজত্ব কিংবা চাকচিক্য ধরে রাখতে পারেননি। পলাশির যুদ্ধের পর ধীরে ধীরে মানুষ কফি পানও কমিয়ে দেয়।
এরপর চা চাষে ব্রিটিশদের ঝোঁক বাড়ে ১৭ শতাব্দীতে। তাদের মূল ক্রেতা ছিল চীন। লিজি কলিংহাম তার বই কারি: আ টেল অব কুকস এন্ড কনকোয়ার্স-এ লেখেন, একসময় ব্রিটেন চা উৎপাদনের বিকল্প জায়গা খুঁজতে থাকে। মাটি এবং আবহাওয়ার কারণে ভারত ছিল চা উৎপাদনের জন্য আদর্শ জায়গা। ১৮৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের নিজস্ব চা উৎপাদন কেন্দ্র চালুর জন্য কমিটি তৈরি করে।
ভারতে তারা শ্রমিকের পাশপাশি ভোক্তাও পেয়ে যায়। চা চাষ বাড়ার সাথে সাথে ভারতীয়দের রুচিরও একসময় পরিবর্তন হয়। ক্যাফে সংস্কৃতির পতনকে আরও সুসংহত করার জন্য ভারতীয়দের কফি হাউসে যাওয়া নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশরা।
তবে বিংশ শতাব্দীতে কফির প্রতি উৎসাহ বাড়তে থাকে। তা প্রথম প্রতিফলিত হয় কলকাতায়। ১৮৭৬ সালে কলকাতাতেই প্রথম ভারতীয় পরিচালিত কফি হাউস চালু হয়। এর নাম ছিল ইন্ডিয়ান কফি হাউস।
ধীরে ধীরে ১৮৯০-এর দশকে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের আরও অনেক শাখা ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো ছিল সাধারণ জনগণের কফি হাউস। যেখানে কোনো ভারতীয় বর্ণবৈষম্য ছাড়াই কফি খেতে পারতেন।
এ ছাড়া বেঙ্গালুরুভিত্তিক কফি ডে গ্লোবালও অনেক বেশি জনপ্রিয় ভারতে। ১৯৯৬ সালে প্রথম কফি হাউস দেওয়ার পর এখন তাদের ৫০০টিরও বেশি আউটলেট আছে। এর ছয় বছর পর স্টারবাকস ভারতের শহুরে বাজারে প্রবেশ করে উপমহাদেশের পানীয়র সংস্কৃতিতে ফের পরিবর্তন আনে।
এসডব্লিউএসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ