সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে গিয়ে সেখানে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অনুসন্ধান ও প্রচেষ্টায় দেশে ফিরেছেন ভুক্তভোগী ১২ নারী কর্মী।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক গত শনিবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, গত মাসে একজন নারী ভুক্তভোগীর স্বামী বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কাছে অভিযোগ করেন, তার স্ত্রী ৬ মাস আগে এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ করতে সৌদি আরবে যান।
কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। লোকমুখে তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
তিনি তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এপিবিএনের সহযোগিতা চান। একইসঙ্গে যে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে তার স্ত্রী সৌদিতে গেছেন সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। এরপর এয়ারপোর্ট এপিবিএনের গোয়েন্দা দল বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে।
জিয়াউল হক আরও জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। ভুক্তভোগী নারী কোথায় কী অবস্থায় আছেন সে বিষয়েও তথ্য জানতে চাওয়া হয়। এরপর অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি সৌদি থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়া ১২ নারী ভুক্তভোগীকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়।
অভিযোগ জানানো ব্যক্তির স্ত্রীসহ নির্যাতনের শিকার ১২ নারী ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শনিবার বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন।
জিয়াউল হক আরও জানান, বিমানবন্দরে পৌঁছলে এপিবিএন তাদেরকে রিসিভ করে। এ সময় ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রকল্পের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। দেশে ফিরে আসা নারীদের কাছ থেকে এপিবিএনের তদন্ত দল বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান যে তারা প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাভেল এজেন্সিসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এপিবিএন-এর এই কর্মকর্তা।
আইন কোথায়?
প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি নারী কাজ করেন তাদের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই৷ একটিই আইন আছে বাংলাদেশে৷ ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক আইন৷ কিন্তু এই আইনে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের ধরা যায়, সৌদি আরবে নির্যাতনের কোনো প্রতিকার করা যায় না৷ আইন অনুযায়ী, কেউ যদি প্রতারণার শিকার হন, শর্তভঙ্গ হয়, নির্যাততিত হন, তাহলে দাযিত্ব হলো রিক্রুটিং এজেন্সির৷
এখানে সাজা ও ক্ষতিপুরণের বিধান আছে৷ তবে এই আইনের বিধিগুলো অস্পষ্ট৷ যদি কেউ নির্যাতনের বা প্রতারণার অভিযোগ করে, তাহলে নিস্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে৷ আরেকটি আইন আছে ২০১৭ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন৷ সেটাও এখানকার জন্য৷
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷”
তিনি জানান, জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷
আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷ আর ওখানে সে থাকবেই বা কিভাবে৷ থেকে যদি মামলা করেও, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা কোথায়?
তিনি আরো বলেন, আমাদের যে আইন আছে তাতে বিএমইটি হয়তো ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারে, কিন্তু নির্যাতনের বিচার তো করতে পারে না৷
এই পরিস্থিতি কেন?
বিশ্বের ২৯টি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে লেবার এটাশে আছে৷ এটা সৌদি আরবেও আছে৷ সেখানে সেফ হোমও আছে৷ তারপরও পরিস্থিতি এত খারাপ কেন?
এ প্রসঙ্গে বিএমইটি’র পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বলেন, যারা নির্যাতনের বা প্রতারণার শিকার হয়, তারা ওইসব দেশে ফৌজদারি মামলা করতে চায় না, কারণ, ফৌজদারি মামলা করলে মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়৷ এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ আমাদের দূতাবাসগুলো তাদের রাখার ব্যবস্থাও করতে পারে না৷
তাছাড়া তাদের আকামার সময়ও শেষ হয়ে যায়৷ তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করে৷ এটা দ্রুত সম্ভব, যদি প্রমাণ করা যায়৷ আর আমরা ২০১৩ সনের আইনে যেটুকু কাভার করে, সেটুকুই করি৷ আমরা রিক্রুটিং এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি৷
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের কোনো শ্রমিক নির্যাতনে মৃত্যুর পর সেখানে কোনো মামলা হয়েছে এমন কোনো নজির এ পর্যন্ত নেই৷ যদি হত্যার ঘটনা প্রমাণ করা যায়, তাহলে ওই দেশের আইনে মামলা হয়৷ কিন্তু প্রমাণ করা যায় না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ