গত মার্চ মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস’-এ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে লেখা হয়েছে: ২০১১ সাল থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র (ধীর ও অবিচলভাবে) অবক্ষয়ের সম্মুখীন, বিশেষ করে ২০১৪ সালে বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরেই (দেশটি) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে ছিল।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার অত্যন্ত কারচুপির নির্বাচন করেছে; যার ফলে তিনি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন এবং (দেশটিতে) দ্বিতীয়বারের মতো কার্যত একদলীয় সংসদ গঠিত হয়। তিনি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে ক্ষমতার চেয়ারে বসেছিলেন।
ওই বিধান তিনি ২০১১ সালে সংবিধান থেকে বাতিল করে দেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্চ মাত্রার অবিশ্বাস, ক্ষমতাসীনদের অধীনে কারচুপির নির্বাচনের ইতিহাস এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার অভাব বিবেচনায় অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকারই ছিল নির্বাচনে জালিয়াতির বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষাকবচ। বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং হেফাজতে মৃত্যু সহ মানবাধিকারের ব্যাপক ও গুরুতর লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো নথিভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে শাসনব্যবস্থা চলছে, তার উন্নয়ন না হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন হবে না বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত স্টেট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার জন ড্যানিলোয়িচ। একসময় বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ডেপুটি মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত মাসিক প্রকাশনা ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস’-এর এডিটর অ্যাট লার্জ হিসেবে কাজ করছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামপ্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফর বিশ্লেষণ করে সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস-এ লিখেছেন: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামপ্রতিক ওয়াশিংটন সফর পর্যালোচনা করলে বেশ কিছু চিত্র উঠে আসে। এসবের মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যালপাসকে (ডেভিড ম্যালপাস) প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতুর একটি ছবি হস্তান্তরের চিত্র। এটি প্রেসিডেন্টের জন্য হাল্কা কোনো আঘাত ছিল না, দুর্নীতির অভিযোগে এক দশক আগে বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে তহবিল দিতে অ-রাজি হয়েছিল। আরেকটি চিত্র হলো- ইউএস চেম্বার অফ কমার্স আয়োজিত মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সভাপতিত্বে। যেখানে তিনি তার দেশে আরও বেশি বিনিয়োগের জন্য পুনঃআহ্বান জানিয়েছেন।
সফর শেষে ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশি এবং মার্কিন কর্মকর্তারা দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব সংলাপ নিয়েও একপ্রস্থ আলোচনা করেন, ২০১৪ সালে যেটির সূচনা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার সমর্থকরা তার সফরের সাফল্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে যে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে এসব ঘটনা এবং চিত্রগুলোর দিকে ইঙ্গিত করবেন। তবে, চিত্রগুলো থেকে আরও কিছু বিষয় উঠে আসে।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। সেটি হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরের বাইরে বিরোধী দলের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সংঘর্ষের বিব্রতকর দৃশ্য। ঠিক যখন ভেতরে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠান চলছিল।
এটি অভিনব কোনো ঘটনা না হলেও, ওয়াশিংটনের রাস্তায় এই বিশৃঙ্খলা, বাংলাদেশের অকার্যকর রাজনীতি যে (দেশের সীমানা ছাড়িয়ে) আন্তর্জাতিক সীমানায় পৌঁছে গেছে তারই বার্তা দেয়। আরও, গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে যে ছবির জন্য মরিয়া ছিলেন, সেটি সম্ভব হয়নি; কারণ দুজনের দেখা হয়নি। যদিও হাসিনা এবং তার সমর্থকরা স্পষ্ট করেই জানেন, এটি কোনো সরকারি সফর ছিল না, কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারলে বেজায় খুশি হতেন।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রশাসনের অবশ্যই এমন অনুরোধে সাড়া দেয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল যদি উভয় পক্ষের সম্পর্ক উষ্ণ থাকতো। এই উপসংহারে আসাটা যৌক্তিক যে, মার্কিন কর্মকর্তারা তো ইতিমধ্যেই মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা পূর্বের বৈঠকগুলোতে জানিয়েছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সামপ্রতিক আলোচনার সময়ও এই বিষয়গুলো উত্থাপন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করার মতো প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য কিছুই ছিল না। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা ঢাকার এক শ্রেণির মানুষের মুখে অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান। সুদানে নৃশংস লড়াই চলছে। এসব ছাড়াও অন্যান্য অসংখ্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখে বাইডেন প্রশাসন। তাই, প্রেসিডেন্ট এবং তার টিম যে মূলত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ওয়াশিংটন সফরকে উপেক্ষা করেছেন, তা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। সামনের দিনগুলোতে, ঢাকার পণ্ডিতরা হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং যুক্তরাজ্য সফরকে হয় (তার পক্ষে) আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য, নয়তো বর্তমান সরকারের (বিরুদ্ধে) নিন্দা জানানোর জন্য ব্যবহার করবেন।
এই মন্তব্যকারীরা নিজেদের বক্তব্য প্রমাণের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যদের বিবৃতিগুলো বিশ্লেষণ করবেন।
যে শিরোনামটি সম্ভবত লেখা হবে না সেটি হলো: বাংলাদেশ এবং তার প্রধানমন্ত্রী (যুক্তরাষ্ট্রের কাছে) ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন, যতটা তারা মনে করেন। বাংলাদেশের যারা ভালো ভবিষ্যতের আশায় আছেন, তারা এই বাক্য থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। যা একই সঙ্গে সহজ এবং উদ্বেগজনক।
যতদিন হাসিনার শাসন বর্তমান রাজনৈতিক পথে চলতে থাকবে ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যমী হবে না।
বাংলাদেশিরা যদি তাদের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা আরও গভীর করতে চায় এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে সুবিধা পেতে চায়, তাহলে তাদের সরকারকে স্বৈরাচারী নীতির সংশোধন করতে হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশকে পশ্চিমারা ক্রমশ খাটো করে দেখবে এবং সেরকম আচরণই করবে। বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই বার্তাটি যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, ততই মঙ্গল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ