ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত তিনদিনের সহিংসতায় অন্তত ৫৪ জন মারা গেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। শুক্রবার রাতে পাহাড়ী এলাকা চূড়াচন্দ্রপুর শহরে উপজাতি মানুষদের এক প্রতিবাদের ওপরে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায় দুজন নারী সহ তিনজন মারা যান। ওই ঘটনাতেই অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে চূড়াচন্দ্রপুর জেলা সরকারী হাসপাতালের এক চিকিৎসক।
পুলিশকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, ১৬টি মৃতদেহ চূড়াচন্দ্রপুর জেলা হাসপাতালের মর্গে রয়েছে, ১৫ টি দেহ আছে ইম্ফলের জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে। ইম্ফল ওয়েস্ট জেলার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে ২৩ টি মৃতদেহ রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদীপ সিং সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ২৮-৩০ জন নিশ্চিতভাবেই এই সহিংসতায় মারা গেছেন। আর বাকি মৃতদেহগুলি এই সহিংসতার কারণেই হয়েছে কী না, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়কে তপশীলী উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কী না, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটা সুপারিশ করার পর থেকে সহিংসতা চলছে। রাজ্যের পাহাড়ী এলাকাগুলোতে এখনও সহিংসতা চলতে থাকলেও রাজধানী ইম্ফলে শনিবার সকালে নতুন করে কোনও ঘটনা ঘটে নি। যদিও পুরো রাজ্যেই কার্ফূ জারি আছে, টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী ও কেন্দ্রীয় অর্ধসৈনিক বাহিনীর সদস্যরা। কেন্দ্রীয় সরকার বৃহস্পতিবার রাত থেকে সংবিধানের ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে।কেই মেইতেই এবং উপজাতিগুলির মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। বহু বাড়ি, গাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিচালনার অভিযোগ
চূড়াচন্দ্রপুরের সরকারী জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সেনাবাহিনী পাহাড় থেকে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষকে নিরাপত্তা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ইম্ফল উপত্যকায় উপজাতি মানুষদের কোনও নিরাপত্তা নেই, তাদের ওপরে আক্রমণ হচ্ছে। উপজাতি মানুষরা দাবী করছিলেন যে এখান থেকে মেইতেইদের যেমন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তেমনই উপজাতির মানুষকেও ইম্ফল থেকে নিয়ে আসা হোক বিনিময় করে। সেই দাবীতেই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন উপজাতি মানুষরা।
‘শহরের ভেনাস হোটেলের সামনে, আমার বাড়ির কাছেই নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। দুজন নারী এবং একজন পুরুষকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ৩০ জন আমাদের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তি আছেন। আমি নিজে সার্জেন, তাই দেহের ক্ষতগুলি পরীক্ষা করতে হয়েছে আমাকে।‘
কেন্দ্র সরকার নিযুক্ত রাজ্যের নতুন নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদীপ সিং চূড়াচন্দ্রপুরের ওই ঘটনা সম্পর্কে সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন যে সেনাবাহিনী আর আসাম রাইফেলসের সদস্যদের সঙ্গে শুক্রবার মানুষের ধস্তাধস্তি হয়। সেনা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ওই চিকিৎসক বলছিলেন শুক্রবার দিনের বেলায় তার হাসপাতালে চারটি গুলিবিদ্ধ দেহ আসে বিষ্ণুপুর আর চূড়াচন্দ্রপুর জেলার সীমান্ত অঞ্চল থেকে।
ওই চিকিৎসক বলেন,“ওই দেহগুলি দেখে আমার মনে হয়েছে যে নিহদের প্রথমে আটক করে হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল। তারপরে অত্যাচার চালানো হয়েছে, আর শেষে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।”
মেইতেই আর উপজাতিদের মধ্যে সহিংসতা যেভাবে শুরু হল
মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে তপশিলী উপজাতি বা এসটি তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবী জানিয়ে আসছিল। তাদের বসবাস মূলত ইম্ফল উপত্যকায়। এদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন যে আদিবাসীরা, তাদের একটা বড় অংশ মূলত কুকি চিন জনগোষ্ঠীর মানুষ। সেখানে নাগা কুকিরাও যেমন থাকেন কিছু সংখ্যায়, তেমনই আরও অনেক গোষ্ঠী আছে। মেইতেইরা তপশিলী উপজাতির তকমা পেয়ে গেলে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত হবেন, এই আশঙ্কা ছিলই।
আবার এখন পাহাড়ী এলাকায় শুধুমাত্র উপজাতির মানুষদেরই জমির অধিকার রয়েছে, মেইতেইরা তপশীলী উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলে তারাও পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করবে, তাদের বনজ সম্পদ ধ্বংস হবে, এই ভয়ও আছে উপজাতিদের।
ওইসব পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সরকার ‘বেআইনি দখলদার’ সরাতে শুরু করেছিল সম্প্রতি। এগুলি সবই নাগা এবং কুকিদের বসবাসের এলাকা ছিল। সেটাও ছিল উপজাতিদের ক্ষোভের একটা কারণ। এইসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনে ঘি পরে ৩ মে, যখন হাইকোর্ট মেইতেইদের তপশিলী উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কী না, সেটা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারকে সুপারিশ করে।
তার বিরুদ্ধে পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করে বুধবার। সহিংসতার শুরু সেখান থেকেই, যা খুব দ্রুত পুরো রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে উপদ্রুত এলাকা থেকে সরিয়ে সেনা শিবিরগুলোতে রাখা হয়েছে
গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি
৬৭ বছর বয়সী আন্নু ডৌঙ্গেল তার স্বামী এবং পরিবারের আরও চারজন বৃহস্পতিবার থেকে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। ইম্ফল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এক উপজাতিদের গ্রামে থাকতেন মিজ ডৌঙ্গেল। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি টেলিফোনে জানিয়েছেন, “স্বামী আর আমি দুজনেই সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে শান্তিতে থাকতে পারব ভেবে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই ঘর ছেড়ে কোনওমতে পালিয়ে আসতে হল আমাদের।“
আন্নু ডৌঙ্গেল জানান,“বৃহস্পতিবার খুব ভোরে খবর আসে যে বহু মানুষ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অ-মেইতেই গ্রামগুলো আক্রমন করতে আসছে। তারা নাকি একের পর এক গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে আসছে। তাড়াহুড়ো করে কিছুটা চাল, কয়েকটা বাসন আর কিছু পোষাক নিয়ে আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।”
এখন তারা আরও অনেকের সঙ্গে পাহাড়ের ওপরে একটা জঙ্গলে ত্রিপল আর বাঁশ দিয়ে তৈরি তাবুতে থাকছেন। চাল ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই, তাই পাহাড়ী ঝর্নার জল, বুনো সবজি, শাক এসব খেয়েই কাটছে তাদের।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০০
আপনার মতামত জানানঃ