প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে মিশর এক বিস্ময়ের নাম। গত ৩০০ বছরে ধরে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে মিশরে। এক সময় অনেকে মনে করতেন মিশরে বড় ধরনের কিছু আর নতুন করে অবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে ইজিপ্টলোজির অনেক পন্ডিতগণ বরাবরই বলে আসছেন, যা আবিষ্কার হয়েছে তার চেয়েও অনেক কিছু অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে।
আসলেই তাই। প্রাচীন মিশরের বিস্ময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এই তো মাস তিনেক আগেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা সাক্কারার প্রাচীন সমাধিভূমিতে খনন করে কয়েক ডজন নতুন মমি এবং ৫৯টি সারকোফ্যাগাস আবিষ্কার করেছিলেন। সারকোফ্যাগাস হচ্ছে কফিন যেখানে মমি রাখা হয়। এসব সারকোফ্যাগাস প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছর আগের।
আর এবার ট্যাপসিরিস ম্যাগনা সাইটে খননকার্য চালিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৬টি প্রাচীন সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু এসব কফিন খুঁজে পাওয়াই মূল বিষয়বস্তু নয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা চমকে উঠেন একটি সারকোফ্যাগাস খোলার পর। একটি মমির মুখের ভেতর থেকে যেন ঠিকরে আসছে আলো। পরে দেখা যায় যে ওটা আসলে একটা সোনার জিহ্বা! এই সোনার জিহ্বাটি নিয়ে আপাতত নানা জল্পনা চলছে প্রত্নতত্ত্বমহলে।
নতুন এই খননকার্য চালায় ইউনিভার্সিটি অব সান্তো দমিনগো’র প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরেই তারা গবেষণা করছেন ট্যাপসিরিস ম্যাগনা সাইটে। তবে সোনার জিহ্বার ঘটনা এটাই প্রথম। অন্য কোনো ঐতিহাসিকদের এমন পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই।
সাধারণত মমি তৈরির সময় শরীরের ভেতর থেকে বার করে নেওয়া হতো নাক, জিহ্বা, অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্ক সবই। শুধু অক্ষত রাখা হতো হৃদপিণ্ডকে। পরবর্তীকালে তা শুকনো করে আবার ভরে দেওয়া হতো কফিনের মধ্যে। গবেষকদের প্রাথমিক ধারণা এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির জিহ্বা অপসারণের পর নতুন স্বর্ণ-জিহ্বা প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে। সঠিক কারণটি নিশ্চিত করে বলা যদিও সম্ভব নয়।
নতুন আবিষ্কৃত এসব সমাধির বয়স প্রায় ২ হাজার বছর। সেসময় গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের যথেষ্ট প্রভাব মিশরজুড়ে। পাথুরে জমিতে কফিন বসানোর চল সেই সময় থেকেই এসেছিল মিশরে। মমিগুলোর বেশ কয়েকটির ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে গেছে শরীরের অংশ। তবে সবগুলোর পাথরের মুখাবরণ ঠিকঠাক আছে। জীবদ্দশায় কাকে কেমন দেখতে ছিল, তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। তবে মমির দেহের মধ্যে সোনার জিভ সংযোজনের বিষয়ে রহস্য উন্মোচন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা দরকার বলে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
মিশরের এই এলাকা অনেক বছর ধরেই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। ক্লিওপেট্রার প্রতিকৃতি শোভিত স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গিয়েছিল এখান থেকে। যা থেকে অনুমান করা হয় যে, ক্লিওপেট্রার সমকালীন ব্যক্তিদেরও এখানে কবর দেওয়া হতো।
সোনার জিহ্বা লাগানো মমির রহস্য এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, মৃত্যুর পরেও যাতে মৃত ব্যক্তি দেবতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এজন্যই না-কি এমনটি করা হয়েছিল। বিভিন্ন ভাষায় মৃত্যুকে চূড়ান্ত ‘বিশ্রামের স্থান’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে মৃত্যুর পরে বিশ্রামের কোনো দর্শন ছিল না। ইহলোক ত্যাগ করার পরে তাদেরকে মৃত্যুর দেবতা ওসাইরিসের দরবারে যেতে হতো বলে বিশ্বাস করতেন মিশরীয়রা। বিশ্বাস অনুযায়ী, সেখানে তাদেরকে ৪২ জন দেবতা ও দেবীর প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। এই পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই তারা প্রেতলোকে স্থান পেতেন। এ কারণেই হয়তো প্রাচীন মিশরীয় কবরগুলোতে মমি’র পাশাপাশি আরও অনেক বস্তু পাওয়া যায়।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুমান করেন, সোনার জিহ্বার মমিটি ৩০ থেকে ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বে টলেমির (৩০ খ্রিস্টপূর্বে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর যখন রোমান সম্রাজ্য মিশর শাসন শুরু করে) শাসনকালে সমাধিস্থ হয়েছিল।
যে মন্দির থেকে মমিটি উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে আরও ১৫টি সমাধির আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। জানা যায়, তাপসিরিস ম্যাগনার মন্দিরে দেবতা ওসিরিস ও তার স্ত্রী আইসিসের প্রতি ভক্তিস্বরূপ তৈরি করা হয়েছিল। এ মন্দির থেকেই প্রাচীন সমাধিসহ আরও মূল্যবান বস্তুও পাওয়া গিয়েছে।
বাকি ১৫টি সমাধিতেও অবাক করা বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। সেখানকার এক মমির মাথায় পাওয়া গেছে মিশরীয় দেবতা আতেফের মুকুট। এর কপালে শিং এবং একটি কোবরা সাপের নকশা করা। আরেকটি মমির মুখ ঢাকা ছিল মার্বেল বসানো মুখোশ দিয়ে। গ্রীক ও রোমান যুগের প্রাচীন শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনেই না-কি এ মমিগুলোকে সমাধি দেয়া হয়েছিল।
উদ্ধারের পর পরীক্ষা-নীরাক্ষা করে গবেষকরা মমিগুলোর মুখ তৈরির চেষ্টা করেন। দেহগুলো এতটাই ভালো অবস্থায় ছিল যে, তাদের চুলের স্টাইলও ঠিকঠাক ছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা এখনো এ মমিগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাথলিন মার্টিনেজ। তিনি বিগত ২০ বছর ধরে মিশরীয় নিদর্শন উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সর্বশেষ এই সমাধিগুলোর আগে ২৭টিরও বেশি সমাধির উদ্ধারকাজ করেছেন তিনি। এই প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, তাপসিরিস ম্যাগনার মন্দিরেই সম্ভবত রানি ক্লিওপেট্টাও শায়িত রয়েছেন!
মিশরের মমি রহস্য দিন দিন যেন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। রহস্য উন্মোচন করতে ঘাম ঝরাচ্ছেন বাঘা বাঘা গবেষকরা। প্রাচীন মিশরের মমি এবং এদের পিরামিড পুরো বিশ্বের মানুষকেই যেন দ্বিধার মধ্যে ফেলে রেখেছে। তবে সেসময় সাধারণ প্রজাদের মৃতদেহ মমি করা হত না। শুধু মাত্র ফারাও এবং অভিজাত ব্যক্তিদের মৃতদেহ মমি করার চল ছিল। মিশরীয়দের ধারণা ছিল, মৃত্যুর পর তাদের আরেক জীবন শুরু হবে। সেখানেও তারা শাসন করবেন তাই তাদের দেহ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার এজন্যই মমির সঙ্গে দিয়ে দেয়া হত তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র।
এমনকি পোষা পশু, পাখি, খাদ্য, শস্য, টাকা-পয়সা, স্বর্নালঙ্কার, পোশাকসহ নানান জিনিসপত্র। আর যে যত বেশি অভিজাত ছিল জীবদ্দশায় তার মমির সঙ্গে তত বেশি মূল্যবান বস্তু থাকত। কফিন তৈরি করা হত দামি কাঠ, পাথর কিংবা সোনা দিয়ে। সম্প্রতি পাওয়া মমির সোনার জিহ্বা পাওয়া তেমনি কারণ হতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য মমির সঙ্গে থাকা দামি মুকুটের পেছনে এখই যুক্তি দাঁড় করান যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ