কথিত আছে, গালে গভীর ক্ষতচিহ্ন এবং উসকোখুসকো দাড়ির জন্যই মানুষের দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল বস্টনের রাজাকে। এক-দুবার নয়, একাধিকবার। আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একটা সময় তাকে ঠেলে দিয়েছিল হতাশার দিকে।
যে রাজাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, একটা সময় গোটা বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করলেও, আদতে তিনি কোনো সম্রাট নন। তখনও পর্যন্ত তিনি কেবলমাত্র একজন নিতান্তই সেলসম্যান। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করাই ছিল তার কাজ। তবে সাধারণ বিক্রয়কর্মী থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম উদ্যোগপতি এবং উদ্ভাবক। হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম মিলিয়নেয়ার।
‘জিলেট’। এই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মূলত, শেভিং ক্রিম এবং রেজারের জন্য পরিচিত হলেও, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বডি কেয়ার পণ্যের জগতে একচেটিয়ে ব্যবসা জিলেটের। ডিওড্র্যান্ট থেকে শুরু করে সাবান, ফেয়ারনেস ক্রিম—সমস্ত ধরনের প্রসাধনীই বাজারে এনেছে জিলেট। আমাদের গল্পের ‘রাজা’ আর কেউ নন, এই ‘জিলেট’-এরই প্রতিষ্ঠাতা। কিং ক্যাম্প জিলেট।
হ্যাঁ, স্রেফ হতাশা থেকেই এক অভিনব পণ্য বাজারে আনার পরিকল্পনা এসেছিল তার মাথায়। আর সেই ‘আশ্চর্য’ পণ্য হল রেজার এবং ব্লেড। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ব্লেড আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত থাকলেও, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে এই ধরনের কোনো সামগ্রীর কোনো অস্তিত্বই ছিল না পৃথিবীতে। কিন্তু কীভাবে ব্লেড আবিষ্কার করলেন জিলেট? সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং।
বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত দাড়ি কামানোর একমাত্র যন্ত্র ছিল ক্ষুর। তবে অসুবিধা হল, এই যন্ত্র ব্যবহারের সময় একটু অসাবধান হলেই রক্তক্ষরণ ছিল অনিবার্য। কখনও আবার সেই ক্ষতচিহ্ন থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে মৃত্যুও ঘটেছে কোনো কোনো ব্যক্তির। ইতিহাস খুঁড়লে উল্লেখ পাওয়া যায় এমন ঘটনারও। জিলেটের সঙ্গে ঘটেছিল তেমনটাই। সেখান থেকেই ক্ষতদাগ। আর যে ক্ষতদাগ দেখেই ভয়ে তার মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিতেন ক্রেতারা।
একটা সময় ভেবেছিলেন দাড়ি বাড়িয়ে ঢেকে ফেলবেন ক্ষতচিহ্ন। তবে লাভ হয়নি তাতেও। এরপর ক্রমশ হতাশা গ্রাস করতে থাকে জিলেটকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামানোর সময় নিজের সঙ্গে প্রায়শই কথা বলতেন কিংবদন্তি উদ্যোগপতি। ঠিক এভাবেই তিনি জন্ম দিয়েছিলেন ‘সেফটি রেজার’ কথাটির। কিন্তু কীভাবে কাজ করবে এই যন্ত্র? তা নিয়েই গবেষণা শুরু হয় তার। যন্ত্রটির নীল-নকশাও তৈরি করে ফেলেন জিলেট।
মূলত, দাড়ি কাটার এই যন্ত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন তিনি—একটি স্ট্যান্ড ও অন্যটি ব্লেড। স্ট্যান্ডটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য হলেও, ব্লেড অর্থাৎ ধারালো ধাতব খণ্ডটি হবে ডিসপোসেবল বা এক ব্যবহারযোগ্য।
জিলেট এই নীল-নকশা তৈরি করেছিলেন ১৮৯৫ সালে। যদিও তা বাস্তবায়িত করতে তার লেগে যায় দীর্ঘ ৬ বছর। হ্যাঁ, কারণ এই যন্ত্রের নীল-নকশা তৈরি করলেও, তিনি যে প্রযুক্তিবিদ নন। ফলে, যন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে তাকে নির্ভর করতে হয় অন্যদের ওপরেই। আর সমস্যা সেখানেই। যে যন্ত্রকে কোনোদিন কেউ দেখেইনি, নামও শোনেনি—তা বানানো কি মুখের কথা? তার উপরে আবার জিলেটের দাবি, তার এই ব্লেডকে তৈরি করে দিতে হবে স্বল্পমূল্যে। সেটা যে ডিসপোসেবল। ফলে, বেশি দাম দিয়ে কিনবেন না ক্রেতারা।
স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ প্রযুক্তিবিদই ফিরিয়েছিলেন জিলেটকে। অবশেষে তার এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে রাজি হন এমআইটির প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক ছাত্র, উইলিয়াম নিকারসন।
১৯০১ সালে প্রথম নিকারসনের হাত ধরেই তৈরি হয় জিলেটের রেজার এবং ব্লেড-এর প্রথম প্রোটোটাইপ। কার্বন-স্টিলের তৈরি সেই ধারালো ব্লেডের আয়তন ছিল মাত্র দেড় ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি। তারপর আরও কিছু পরিবর্তন করা হয় তাতে। ধাতব পাতটির মাঝে সংযুক্ত করা হয় স্ক্রু আটকানোর গর্ত।
কেননা স্ক্রু দিয়েই এই ব্লেড আটকাতে হত স্ট্যান্ড বা রেজরের সঙ্গে। কিন্তু কেমন দেখতে ছিল এই ব্লেড? অনেকের মনেই হয়তো এসেছে এই প্রশ্নটা। আজকে আমরা যে ব্লেড ব্যবহার করে থাকি, হুবহু একই আকৃতি ও আয়তন ছিল জিলেটের ব্লেডের। বা বলা ভালো, জিলেটের তৈরি ব্লেড অপরিবর্তিত হয়েই ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রায় একশো কুড়ি বছর ধরে। সেই প্রসঙ্গও আসবে একটু পরে…
যাই হোক, এর পর ১৯০৩ সালে দক্ষিণ বস্টনে আস্ত একটি কারখানা তৈরি করে ফেলেন কিং জিলেট। শুরু হয় সেফটি রেজারের বাণিজ্যিক উৎপাদন। ততদিনে পেটেন্টের জন্যেও আবেদন করা হয়ে গেছে তার। তবে প্রথম বছরের ফলাফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। সেবছর বিক্রি হয়েছিল মোটে ৫১টি রেজার এবং দেড়শোটি ব্লেড। যদিও সেটা ছিল বিপ্লবের শুরু।
১৯০৪ সালে বিক্রি হয় ৯১ হাজার রেজার এবং দেড় লক্ষাধিক ব্লেড। ১৯০৬ সালে তার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে কানাডা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশেই। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনানীদের নিরাপত্তার জন্য জিলেটের থেকে পাইকারি হিসাবে রেজর ও ব্লেড কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিটি সেনাকেই প্রদান করা হয়েছিল জিলেটের সেফটি রেজর। কেবলমাত্র সেনাবাহিনীতেই ব্যবহৃত হয়েছিল ৩ কোটি ২০ লক্ষ ব্লেড।
এই ব্যবসাই মাত্র কয়েক বছরে তাকে করে তুলেছিল মিলিয়নেয়ার। বস্টন শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কেননা, এই বাজারে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না কেউ-ই। ১৯০৪ সালেই যে সেফটি রেজারের পেটেন্ট জুড়েছে তার নামের পাশে। ফলে, অন্য কোম্পানির পক্ষেও অসম্ভব হয়ে ওঠে এই যন্ত্রের পুনরুৎপাদন করা।
অন্যদিকে ব্লেডের পেটেন্ট পেয়েছিলেন নিকারসন। তার থেকে ব্লেডের স্বত্ব কিনে ব্লেড উৎপাদন শুরু করেছিল একাধিক সংস্থা। যদিও ব্লেড ব্যবহারের একমাত্র যন্ত্র ছিল জিলেটের রেজার। তাই ব্লেড তৈরির ক্ষেত্রে তারাও অনুসরণ করেন জিলেটের নকশাই। আজও যা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ১৯৩২ সালে মারা যান জিলেট। তারও পরে সেফটি রেজরের জগতে আত্মপ্রকাশ করে অন্যান্য প্রস্তুতকারক সংস্থারা। বলতে গেলে প্রায় ৩ দশক ধরে গোটা বিশ্বে শেভিং-এর জগতে রাজত্ব করেছিলেন কিং ক্যাম্প।
এসডব্লিউএসএস/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ