কবির হোসেন: ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েকদিন ধরেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ(ডিএমপি) কড়া নির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন। নিষেধাজ্ঞা জারি করে আসছিলেন লোক জমায়েতের বিপক্ষে। তার কতটা করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত থাকলেও অধিকাংশই ছিলো নিরাপত্তাজনিত কারণ। অনেকে মনে করেন, ধর্মীয় বিধি নিষেধের ব্যাপারটাও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে ডিএমপি ঘোষিত নির্দেশনাতে। তবে ডিএমপি কর্তৃক জানানো হয়েছিল পুরোটাই ছিল করোনা ভাইরাস জনিত নিরাপত্তা বিধান।
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে ডিএমপি যেসব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তা এক লম্বা তালিকাই বটে। সেখানে লোক জমায়েতের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ছিল মানুষের অভ্যন্তরীণ উদযাপনের বিষয়টিও। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, উৎসব উদযাপনের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে থাকে। কতিপয় ব্যক্তি আনন্দের আতিশয্যে পটকাবাজি, আতশবাজি, অশোভন আচরণ, বেপরোয়া গাড়ি ও মোটরসাইকেল চালানোর মাধ্যমে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা/দুর্ঘটনা ঘটিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। এ সকল নৈতিক মূল্যবোধ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়। অন্যথায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা সৃষ্টি করে এমন কোন কর্মকাণ্ড রোধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বদ্ধপরিকর থাকবে।
এছাড়াও ঢাকা মহানগরীতে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে ১৩টি নির্দেশনাও দিয়েছিল ডিএমপি। সেখানে ঢাকা মহানগরের সার্বিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে রাস্তার মোড়, ফ্লাইওভার, রাস্তায়, ভবনের ছাদে এবং প্রকাশ্যে স্থানে কোন ধরণের জমায়েত/সমাবেশ/উৎসব করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা ছিল। একই সাথে উন্মুক্ত স্থানে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে কোথাও কোন ধরনের আতশবাজি/পটকা ফোটানো যাবে না। কোনো কোনো এলাকাতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ ছিলো আরো অনেক কিছু নির্দেশনা।
কিন্তু ডিএমপির এসব নিষেধাজ্ঞা মানা হয়েছে থোরাই। নববর্ষ উদযাপনে লোকজন দমিয়ে রাখতে পারেনি ডিএমপি। রাত ঠিক বারটায় আতশবাজির ঝলকে রঙ্গিন হয়ে উঠেছিল ঢাকার আকাশ, পাশাপাশি পটকার শব্দে প্রকম্পিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকা।
এবার নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছিল মানুষের বাসা-বাড়ির ছাদকেও। কিন্তু অনেকেই ছাদে বারবিকিউ পার্টিসহ পারিবারিক নানা আয়োজন করেছেন নতুন বছরের প্রথম মূহুর্তটি স্মরণীয় করে রাখবার জন্য। আবার সাধারণ মানুষের আয়োজন নিষিদ্ধ থাকলেও তারকা হোটেলগুলোতে পার্টি, ডিসকোসহ নানা আয়োজনে অংশ নিয়েছে উচ্চবিত্তের অসংখ্য মানুষ।
ঢাকার প্রতিটা ভবনের ছাদ ছিলো উৎসবমুখর। বিভিন্ন রঙের বাতিতে ছিলো আলোকজ্জ্বল। ছাদে বিভিন্ন পার্টিসহ সংগীতমুখর ছিল ঢাকার আবহাওয়া। আর ঢাকার আকাশে এতো এতো ফানুস ওড়ানো হয়েছে যে আকাশের তারারাও বোধহয় চমকে গেছেন পৃথিবীতে এতো এতো আলোকজ্জ্বল তারকারাজি দেখে।
ঢাকার অধিবাসী কেউ কেউ মনে করেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন বেশি উৎসবমুখর ছিলো, বেশি মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই মানুষ কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারছিলেন না, অংশগ্রহণ করতে পারছিলেন না কোনো দাওয়াতেও। মানুষের ভেতর অবদমিত হয়ে থাকা এসব আনন্দ যেন বিস্ফারিত হয়ে ফেটে পড়েছে। লঙ্গণ করেছে করোনার বিধি নিষেধ, ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা। যেন তারা আর পেরে উঠছিলেন না ভেতরে থাকা চাপা যন্ত্রণার সাথে। তাই যেন সুযোগ আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদযাপনে।
লোকজনের এমন বাঁধ ভাঙা আনন্দ উৎসবে ডিএমপিকে যেন খুবই অসহায় লেগেছে। তারা যা যা নিষেধ করেছেন লোকজনও তা তা অক্ষরে অক্ষরে ভেঙেছেন। থামানো যায়নি তাদের ডিএমপির কঠোর নির্দেশনা দিয়ে। এমনকি থামাতে পারেনি করোনা আতঙ্কও।
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, আসলে পুলিশ এখনো জনমুখী হতে পারেনি। লোকজনের নাড়িনক্ষত্র এখনো তারা গুনতে পারেননি। লোকজনের মানসিকতাকে এখনো রপ্ত করতে পারেননি তারা। তাইতো লোকজন যেসবের জন্য এতোদিন মুখিয়ে আছেন সেসবেই দিয়ে দিলেন কড়া নিষেধাজ্ঞা। নাকি লোকজন এখন আর পুলিশকে মানছে না?
আইন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশ রাষ্ট্রের অপরাধচক্রে এমনিভাবে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন যে লোকজন এখন আর তাদের রক্ষক ভাবছেন না। রাজনীতিবিদদের মতোই একটি সংগঠন মনে করে পাশ কাটিয়ে চলে যান। অর্থাৎ জনগণের বিশ্বাস পুলিশ এতোবার ভেঙ্গেছেন বা ভেঙ্গে যাচ্ছেন যে লোকজন পুলিশের ওপর কোনো আস্থাই আর রাখতে পারছেন না। অথবা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে জনগণের বিপরীতে।
তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, জনগণের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। একটি রাষ্ট্রের অবকাঠামো ঠিক রাখতে আইনের আবশ্যিকতা রয়েছে। আইন ভঙ্গের প্রবণতা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে। অরাজকতা তৈরী হতে পারে। আবার বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, যেখানে আইন রক্ষকদেরই আইন ভঙ্গের প্রবণতা রয়েছে, উল্টো জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রের বিবিধ অপরাধকর্মে, সেখানে জনতার মাঝে আইনের শৃঙ্খলা প্রত্যাশা করা যায় না।
এসডাব্লিউ/২১০৭
আপনার মতামত জানানঃ