স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক লেনদেনে মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। তখন পর্যন্ত বিনিময় হার ওঠানামা করত পাউন্ডের বিপরীতে। এর পর থেকে বাংলাদেশ মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে পাউন্ডের পরিবর্তে বেছে নেয় ডলারকে। সেই শুরু ডলারের ওপর নির্ভরতা। সেই ডলারই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা। নানা সময়ে ডলারের আধিপত্য ভাঙা নিয়ে আলোচনা ও উদ্যোগ হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরও শক্তিশালী হয়েছে এই মার্কিন মুদ্রা। আর এই শক্তিশালী মুদ্রাই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
বাংলাদেশে গত বছর থেকে যে ডলার সংকট শুরু হয়েছিল, এ বছরেও পরিস্থিতি উন্নতির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো ডলারের অভাবে তারা ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি মূল্য মেটাতে না পারায় পণ্য নিয়ে বন্দরে আটকে রয়েছে জাহাজ। এমনকি সরকারি অনেক উদ্যোগও ডলার সংকটের কারণে জটিলতায় ভুগছে। যদিও এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন যে, নতুন বছরে নাগাদ ডলার সংকট মিটে যাবে। সংকটের কোন সমাধান তো দেখা যাচ্ছেই না, উল্টো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে, বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমালেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার অপরিবর্তিত রেখেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। যদিও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরেও প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। আগামী বছরে তা কমে সাড়ে ৬ শতাংশে নামতে পারে। আর প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি চলতি বছরে কমলেও আগামী বছরে বেড়ে যাবে। ফলে ডলার সংকট আগামী বছরে আরও বাড়বে। মঙ্গলবার রাতে প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক এপ্রিল ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু ইতিবাচক কথা বলেছে আইএমএফ। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট চলছে তা ধীরে ধীরে কিছুটা কমে আসবে। ফলে চলতি বছর বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে (বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের হিসাব) ঘাটতি হবে জিডিপির আকারের ২ দশমকি ১ শতাংশ। গত বছরে এ খাতে ঘাটতি হয়েছিল জিডিপির আকারের ৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি কমে প্রায় অর্ধেক হবে।
আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে জিডিপির আকারের ৪ দশমিক ২ শতাংশ হবে। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঘাটতি। ঘাটতি এত বেশি হওয়ার মানে হলো-ওই বছর ডলার আয়ের চেয়ে খরচ অনেক বেশি হবে। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর আইএমএফ বলেছে, আগামী অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমবে। জিডিপি বাড়ার কারণে আমদানি বাড়বে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়বে। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছবে। এটিই হবে সর্বোচ্চ ঘাটতি।
সূত্র জানায়, আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ডলার পেয়েছে। এ কারণে রিজার্ভ সামান্য বেড়েছিল। এখন আবার কমতে শুরু করেছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ছয় মাসের মধ্যে ১ দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গত অক্টোবরে বলেছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু এপ্রিলে তা কমিয়ে বলেছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। বিশ্বব্যাংক গত জুনে বলেছিল চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এপ্রিলে তা কমিয়ে বলেছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হবে।
বৈশ্বিক মন্দা, রপ্তানি বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া এবং সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমবে বলে সংস্থা দুটি জানিয়েছে।
আইএমএফের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্ব জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। এটা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বলেছিল, প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। তিন মাসের মধ্যে এ হার দশমিক ১ শতাংশ কমানো হলো। আগামী বছর তা সামান্য বেড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তিন মাস আগে বলা হয়েছিল, আগামী বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দার কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমানো হলো।
চলতি বছরে ভুটানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের হতে পারে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। মিয়ানমারের ২ দশমিক ৬ শতাংশ। নেপালের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। শ্রীলংকার প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে হয়েছিল ৩.৩ শতাংশ। গত বছরে প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। উলটো কমে নেগেটিভ হয়েছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছরে ৩ শতাংশ নেগেটিভ হবে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এবার তা কমে ১ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। ইউরোপীয় অঞ্চলে গত বছর হয়েছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এবার তা কমে হবে ০ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছর যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ শতাংশ এবার তা কমে নেতিবাচক দশমিক ৩ শতাংশ হবে। উল্লেখ্য, এসব দেশ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার। এই দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি কমার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হবে। ভারতের প্রবৃদ্ধি গত বছর হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এবার তা কমে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। গত বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছর তা কমে ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
আইএমএফ বলেছে, নতুন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সুদের হার বেড়ে যাওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে নীতি সুদের হার ৫০ থেকে শতভাগ বা এর চেয়ে বেশি বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। কারণ সুদের হার বাড়ার কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে যাবে।
জানা যায়, বাংলাদেশেও নীতি সুদের হার ইতোমধ্যে তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোও সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। আগামী জুলাই থেকে এ হার আরও বেড়ে যাবে। তখন ঋণের খরচও বাড়বে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ