প্রযুক্তির দুনিয়ায় এই মুহূর্তের চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুধু চর্চা নয় বেড়েছে ব্যবহারও। মানবসভ্যতার উন্নয়নে এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে দিন রাত গবেষণা চালাচ্ছেন বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার গবেষকরা। তাদের ধারণা, এক নতুন যুগের শুরু হতে চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যখন এত শোরগোল। ঠিক তখনই এই প্রযুক্তি নিয়ে সাবধান বাণী শোনা গেল খোদ এআই গবেষকের মুখে।
এই যেমন গত বছর ক্রিস কাশতানোভা নামের একজন শিল্পী নিজস্ব সৃজনশীল এআই প্রোম্পটের মাধ্যমে ইমেজ জেনারেটর এআইয়ের সাহায্যে একটি গ্রাফিক নভেল তৈরি করেন। এরপর থেকেই বিতর্ক শুরু হয়েছে এই ছবিগুলোর মেধাস্বত্ব কার: নির্দেশ দেওয়া মানুষের নাকি নির্দেশ অনুযায়ী আর্ট তৈরি করা এআইয়ের?
অসাধারণ সব ছবি তৈরি করতে সক্ষম এআই প্রোগ্রাম মিডজার্নিতে ঢোকেন কাশতানোভা। এরপর ‘সেন্ট্রাল পার্ক থেকে জেনডায়া বের হচ্ছে…’ কিংবা ‘ভবিষ্যতের খালি নিউ ইয়র্ক শহরের সাই-ফাই দৃশ্য…’—এরকম ইনপুট লিখে মিডজার্নির কাছ থেকে ছবি তৈরি করিয়ে নেন।
এ ধরনের ইনপুট থেকে কাশতানোভা ১৮ পৃষ্ঠার একটি গ্রাফিক নভেল তৈরি করেন। ওই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে অভিনেত্রী জেনডায়ার মতো চেহারার তরুণী জারিয়া। আর গল্পের মূল বিষয়বস্তু ভবিষ্যতের নিউ ইয়র্কে জারিয়ার অভিযান। গত সেপ্টেম্বর মাসে কাশতানোভা তার এই গল্পের কপিরাইট করিয়ে নেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেন এআই দিয়ে তৈরি ছবির কপিরাইট থাকবে মূলত শিল্পীদের কাছে।
তবে এই দাবি বেশিদিন টেকেনি। ফেব্রুয়ারিতেই ইউএস কপিরাইট অফিস এই ছবির ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। কাশতানোভা হয়ে ওঠেন প্রথম ব্যক্তি যিনি এআই আর্টের আইনি সুরক্ষার অধিকার হারান। কপিরাইট অফিস জানায়, ‘জারিয়া’র ছবিগুলো ‘কোনো মানুষের তৈরি ছবি নয়’। তবে কাশতানোভাকে গল্পের স্টোরিলাইন এবং ছবি সাজানোর কপিরাইট দেওয়া হয়।
এখন খুবই শক্তিশালী একদল আইনজীবীকে নিয়ে এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কাশতানোভা। একটি নতুন বইয়ের জন্য স্টেবল ডিফিউশন নামের আরেকটি এআই প্রোগ্রাম ব্যবহার করছেন তিনি। স্টেবল ডিফিউশনের মাধ্যমে শিল্পীর নিজের আঁকা স্কেচ স্ক্যান করে এআই প্রোম্পটের মাধ্যমে ছবিটিকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করা সম্ভব। তার বিশ্বাস, আসল ছবিতে মানুষের ছোঁয়া থাকায় সেটি কপিরাইট পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।
নিজের আত্মজীবনীমূলক কমিক বইটি নিয়ে এই ৩৭ বছর বয়সী মন্তব্য করেন, “খুবই অবাক করা বিষয় হবে যদি একে কপিরাইট না করা যায়।” এদিকে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের কপিরাইট অফিস ও মিডজার্নি। স্ট্যাবিলিটি এআইও মন্তব্য করার অনুরোধের কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি।
চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নি আর স্টেবল ডিফিউশনের মতো এআই প্রোগ্রামগুলো এখন ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে একের পর এক রেকর্ড ভেঙে গেলেও আইনি ব্যবস্থা এখনো মেধাস্বত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মেধাস্বত্ব ব্যবহারকারীদের কাছে থাকবে নাকি প্রোগ্রাম প্রস্তুতকারকদের কাছে থাকবে, নাকি কারো কাছেই থাকবে না, তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি কপিরাইট অফিস।
তবে আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উত্তরের ওপরেই নির্ভর করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ভাগ্য। ব্যবহারকারী কিংবা এআই প্রোগ্রামগুলোর মালিক, কপিরাইট যার কাছেই থাকবে সে এখান থেকে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা পাবে বলে মন্তব্য করেন কপিরাইট লাইসেন্স নিয়ে কাজ করা ক্রিয়েটিভ কমন্সের সাবেক প্রধান রায়ান মার্কলি।
মার্কলি জানান, “কোম্পানিগুলো এআইকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন, ব্র্যান্ডিং বা বিনোদন খাতের জন্য ব্যাপক হারে কমদামি গ্রাফিকস, মিউজিক, ভিডিও কিংবা টেক্সট উৎপাদন করতে পারবে। কপিরাইট নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে কম্পিউটার-জেনারেটেড কাজগুলোর ব্যাপক মাত্রার জন্য।”
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বেশ কিছু দেশে যিনিই কোনো সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার কাজের জন্য আইনি সুরক্ষা যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে শিল্পীকে আলাদাভাবে আদালতে যেতে হয়, যাতে তিনি নিজের অধিকার খাটাতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, মূল শিল্পীকে অবশ্যই মানুষ হতে হবে। কাশতানোভার ‘জারিয়া’র ক্ষেত্রেও একই যুক্তি দেখানো হয়েছে।
এদিকে স্টিফেন থ্যালার নামের একজন মার্কিন কম্পিউটারবিজ্ঞানী জানিয়েছেন, তার এআই প্রোগ্রাম সংবেদনশীল এবং তার এআই প্রোগ্রামের তৈরি করা ছবি তার নামেই কপিরাইট করতে হবে, কারণ এআই তার নিজের আবিষ্কার। এ ব্যাপারে তিনি ইউএস কপিরাইট অফিসের বিরুদ্ধে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টেও এ বিষয়ে একটি পেটেন্ট মামলা চলমান।
তবে ইতিমধ্যেই অনেক শিল্পী এবং সৃজনশীল কাজের মালিক কোম্পানিগুলো (যেমন: গেটি ইমেজেস) এআই ব্যবহারকারী ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে কপিরাইট দেওয়ার কঠোর বিরোধিতা করেছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, এআই প্রোগ্রামগুলোকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে মূলত ইন্টারনেটের বিশাল মুক্ত ভান্ডারের মাধ্যমে এবং এই ইন্টারনেট ভান্ডারের অনেক ছবি কপিরাইটের আওতাভুক্ত। এআই প্রোগ্রামগুলো কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই এই কপিরাইটকৃত ছবিগুলো ট্রেনিং করার কাজে ব্যবহার করেছে।
মিডজার্নি, ওপেনএআই এবং স্ট্যাবিলিটি এআইয়ের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কপিরাইটভঙ্গের অভিযোগে মামলা করেছে স্টক ছবি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গেটি ইমেজেস। এদিকে কোম্পানিগুলোও কপিরাইটভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিষ্ঠানই মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
‘জারিয়া’র কপিরাইট বাতিল হবার পর কাশতানোভা লিংকডইনে আইনি সহায়তার জন্য পোস্ট করলে আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান মরিসন ফোয়ের্স্টার বিনামূল্যে তাকে সহায়তা করতে রাজি হয়। প্রতিষ্ঠানটির কপিরাইট আইনজীবী জো গ্রাৎস বলেন, “সিদ্ধান্তের ফলাফল কোন দিকে গড়াবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সবার ওপরেই এর প্রভাব পড়বে।”
এদিকে কপিরাইট অফিস প্রথমে জারিয়ার কপিরাইট কাশতানোভাকে দিলেও পরে সেটি বাতিল করার কারণ হিসেবে মন্তব্য করেছে, “আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম ছবিগুলো তিনিই এঁকেছেন। কিন্তু পরে আমরা তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানতে পারি ছবিগুলো এআইয়ের তৈরি করা। তখনই আমরা এটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিই।”
এদিকে মার্চের ১৬ তারিখে কপিরাইট অফিস বলেছে, কপিরাইট আবেদনকারী তার শিল্প তৈরি করতে কোনো এআইয়ের সহায়তা নিয়েছেন কি না, তা যেন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেন। নতুন এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এআই সিস্টেমগুলো কপিরাইট করতে সক্ষম এমন শিল্প তৈরি করে না এবং ‘এই শিল্পগুলোর ওপর মানুষের সংযোগ আছে কি না, সেটিই সবচেয়ে বড় বিষয়।’
করোনা মহামারির সময় ইয়োগা ও এক্সট্রিম স্পোর্টস ফটোগ্রাফার হিসেবে কাশতানোভার কাজের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ার পর গত আগস্ট মাসে মিডজার্নি আবিষ্কার করেন তিনি।
“আমি সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গিয়েছি,” বলে মন্তব্য করেন কাশতানোভা। এআই প্রযুক্তির দ্রুতগতির এই বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি নতুন নতুন টুল ব্যবহার করছেন নিজের কাজকে আরও ভালো করার জন্য।
মানুষের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকলে সেটি কপিরাইট অফিস অনুমোদন করবে, তা নিয়ে এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন কাশতানোভা। আত্মজীবনীভিত্তিক কমিকসের প্রতিটি ছবির জন্য তিনি আলাদা আলাদা এআই প্রোগ্রাম ব্যবহার করছেন।
কাশতানোভা এখন এমন এক এআই প্রোগ্রাম তৈরির কাজ করছেন যা বাচ্চাদের আঁকা স্কেচকে কমিক বইয়ে রূপান্তর করতে পারবে। ‘রোজা এনিগমা’ নামের এরকমই এক ছবি কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি প্রকাশ করেছেন।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনের এক অ্যাপার্টমেন্টে বসে কাশতানোভা তার নতুন পদ্ধতি দেখালেন। প্রথমেই কলম দিয়ে একটা কাগজে স্কেচ করলেন। এরপর সেটিকে স্ক্যান করে স্টেবল ডিফিউশনে ইনপুট দিয়ে বিভিন্ন সেটিংস পরিবর্তন করে ‘সাইবার তরুণী’ এবং ‘মাথার ভেতর থেকে ফুল বের হয়ে আসছে’—এমন ইনপুট দিলেন।
যে ফলাফল বের হয়ে এল, তা এক অদ্ভুত কাল্পনিক ছবি। ছবিটির মুখের নিচের অংশ ঠিক থাকলেও ওপর থেকে একঝাড় গোলাপ ফুল বের হয়ে এসেছে। কাশতানোভা এরপর ছবিটিকে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য কপিরাইট অফিসে জমা দিয়েছেন। ছবিটি কাশতানোভার নতুন বই ‘ফর মাই এআই কমিউনিটি’-তেও প্রকাশিত হবে।
এসডব্লিউএসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ