বাংলাদেশের একটি গবেষণা সংস্থা সিপিডি-র হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ অর্থবছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। আর ২০২৩ অর্থবছরে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকায়।
দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও নানা সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি কিছু ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পাচারের অভিযোগ উঠেছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাদায়ী ঋণের একটি বড় কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করেই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে বড় আকারে ঋণ অনুমোদন দেয়া।
ঋণ যেন খেলাপি বা অনাদায়ী না হয়ে যায়; সে জন্য সতর্ক নজরদারি বজায় রাখতে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রবিবার বাংলাদেশে ব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের যে সভা হয়েছে, তাতে এই পরামর্শ দেয়া হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ, ঋণ আদায় বা এ জাতীয় বিষয়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হয়। ২০০৩ সালে এ আদালত গঠনের পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এতে মোট মামলা হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার। সেসব মামলায় দাবি করা অর্থমূল্য ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থ ঋণ আদালতগুলোয় বর্তমানে প্রায় পৌনে এক লাখ খেলাপি ঋণের মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। ফলে একদিকে যেমন ঋণ আদায়ে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না, তেমনি খেলাপির সংখ্যা আরও বড় হচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হয়েছে?
এতো মামলা কেন হয়েছে?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্ট এবং আইনজীবীরা বলছেন, কয়েকটি কারণে অর্থ ঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে।
সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলছেন, যখন ব্যাংকগুলো বুঝতে পারে যে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আর খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না, চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসাবে তারা মামলায় যায়।
‘দেশে এই মামলার একমাত্র আদালত হচ্ছে অর্থ ঋণ আদালত। ক্রেডিট কার্ড খেলাপি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোটি কোটি টাকার ঋণ খেলাপি- সব মামলায় সব ব্যাংককে এই একটা আদালতেই যেতে হয়। যখন ঋণ আদায়ের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, আমরা আশা ছেড়ে দেই, তখন সেটাকে রাইট-অফ করার জন্যও মামলা করতে হয়। সেই কারণে এখানে কেসের সংখ্যা অনেক বেশি।’
আবার অর্থ ঋণ আদালতে কোন মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্যও আরেকটি মামলা করতে হয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এরকম চারটি আদালত থাকলেও জেলা শহরগুলোয় একটি করে আদালত রয়েছে। অর্থ ঋণ মামলা পরিচালনাকারী একজন আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বলছেন, ‘ঢাকার অর্থ ঋণ আদালতগুলোর কয়েকটিতে এখনো বিচারক নেই। এটাই আসলে সবচেয়ে প্রধান সংকট।’
সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ‘আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রায় নিয়মিতভাবে বিচারক থাকেন না, জনবলের অভাব রয়েছে। ফলে সেখানে জমে জমে মামলার সংখ্যা বাড়ে, মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও বাড়ে। কারণ মামলার যেকোনো সময় সীমা নেই। হয়তো শুনানির দিন বিচারক উপস্থিতি নেই। এসব কারণে দিনের পর দিন ধরে মামলা চলতে থাকে। তার সঙ্গে নতুন নতুন মামলা এসে যোগ হতে থাকে।’
ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, কোন অনাদায়ী ঋণ অবলোপন করতে হলে আগে মামলা করতে হবে। ফলে ব্যাংক যদি কখনো বুঝতেও পারে যে, এই ঋণ আর আদায়যোগ্য নয়, তাহলে সেটা তাদের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার জন্য এবং আদায়ের চেষ্টা করার জন্যও মামলা করতে হয়।
মামলায় এতো দীর্ঘসূত্রিতা কেন?
আইনজীবী মোহাম্মদ তরিক উল্লাহ বলছেন, মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলার প্রধান কারণ বিচারক এবং আদালতের লোকবল সংকট। ফলে মামলা হলেও সেখানে কোন গতি থাকে না।
‘বিচারক না থাকায় হয়তো ঠিকমতো শুনানি হয় না। অনেক সময় বিবাদী পলাতক থাকে, হয়তো দেশের বাইরে চলে গেছে। তখন মামলাগুলো ঝুলে থাকে।’
তিনি বলছেন, খেলাপি ঋণ ঠিকমতো আদায় করতে না পারার পেছনে অনেক সময় ব্যাংকের গাফিলতিও দায়ী হয়ে থাকে। কারণ যখন ঋণ দেয়া হয়ে থাকে, সেখানে যাচাই-বাছাই, সম্পত্তির মূল্যায়ন ইত্যাদিতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটা গাফিলতি দেখা যায়। পরবর্তীতে বিচার কার্যক্রমে গিয়ে বাস্তবের সঙ্গে অনেক কিছুর মিল পাওয়া যায় না।
‘হয়তো মর্টগেজের কাগজপত্র ঠিক মতো নেই। হয়তো বন্ধক রাখা সম্পদের মূল্য যতটা দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার দাম অনেক কম। ফলে নিলাম হলেও দেখা যায়, সেই টাকা উঠে আসে না। ফলে রিকভারি করা নিয়েও অনেক সময় ব্যাংকের ভেতরে অনীহা থাকে।’
সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলছেন, ব্যাংক তার পক্ষে আদেশ পাওয়ার পর যখন সেটা কার্যকর করার বা টাকা আদায়ের চেষ্টা করে, তখন অনেকে উচ্চ আদালতে গিয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিট করেন। ফলে সেসব আদেশের বাস্তবায়নও দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়ে যায়।
এসডব্লিউএসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ