রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ২০০৯ সালে ম্যাককিনি ইসলামিক সেন্টারে যান। সমবেত শত শত মুসলিমকে হত্যার জন্য তিনি মসজিদে বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন। মসজিদে বোমা লুকিয়ে রাখার জায়গা খুঁজছিলেন ম্যাককিনি। তিনি বলেন, ‘আমি জনগণকে বলেছি, ইসলাম ক্যানসার। আর আমি অস্ত্রোপচার করে এই ক্যানসার সারাব।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে ইসলামিক সেন্টার অব মানসির কয়েকজন সদস্য তাকে মসজিদের দিকে হেঁটে আসতে দেখছিলেন। দেখেই তারা বুঝে গিয়েছিলেন, যিনি হেঁটে আসছেন, তিনি স্বাভাবিক নেই। কোথাও গরমিল আছে।
স্বাস্থ্যবান দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি মসজিদের দিকে মাথা নিচু করে আসছিলেন। রাগে মুখ লাল হয়েছিল তার। ইন্ডিয়ানার মানসি শহরের মানসি ইসলামিক সেন্টারের মসজিদে শুক্রবার ভিড় ছিল অনেক। সেই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। তার ডান হাতের বাহুতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উল্কি ইউএসএমসি আঁকা ছিল। আর বাঁ হাতে আঁকা ছিল মাথার খুলির উল্কি। তিনি বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন।
তার নামটি পরে জেনেছিলেন ইসলামিক সেন্টারের সদস্যরা। জেনেছিলেন, রিচার্ড ‘ম্যাক’ ম্যাককিনি নামের ওই ব্যক্তি হামলার পরিকল্পনা নিয়ে ঢুকেছিলেন মসজিদে। তিনি সাবেক মার্কিন নৌসেনা।
ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় ম্যাককিনি মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন। নিজের শহর মানসিতে ফেরার পর ম্যাককিনি দেখেন, সেখানে মুসলিমদের বসতি গড়ে উঠেছে। প্রাথমিক স্কুলে মুসলিম বাচ্চাদের সঙ্গে তার সন্তানদের ক্লাস করতে হতো। সেটাও মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।
পরিকল্পনা অনুসারে এগোচ্ছিলেন ম্যাককিনি। তবে মসজিদে ঢোকার পর এমন কিছু ঘটে যায়, যা তিনি কখনো ভাবেননি। ভাবতে পারেননি, তিনি যাদের জীবন শেষ করে দেবেন বলে ভেবেছিলেন, তারাই তার জীবন বদলে দেবেন।
মসজিদে ম্যাককিনির সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা ছিল নাটকীয়। যেন সিনেমার গল্প। আর তাই বলে কি ম্যাককিনির সেই গল্প নিয়েই বানানো হলো স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) ‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’। ২০২২ সালে ট্রিবেকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি বিশেষ জুরি পুরস্কার জেতে।
সিনেমায় দেখানো হয়েছে, কী কারণে ম্যাককিনি মসজিদে হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে এলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় আজ রোববার ‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’ স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের তালিকায় উঠবে। এর প্রযোজকদের একজন হলেন পাকিস্তানের নোবেলজয়ী অধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই।
ম্যাককিনি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সম্প্রতি সিএনএনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার পরনে ছিল নীল রঙের টি-শার্ট। তাতে লেখা ছিল, ‘সে নো হেট টু হেট’। লম্বা শুভ্র দাঁড়িতে তাকে সান্তা ক্লজের মতো দেখাচ্ছিল।
ম্যাককিনি বলছিলেন সেই শুক্রবারের গল্পটা। সেদিন তিনি ভেবেছিলেন, ওই দিনই তার শেষ দিন। ম্যাককিনি বলেন, ঘটনার আগে শেষরাতের দিকে ভেবেছিলাম, তারা আমাকে ধরতে পারলে মেঝেতে শুইয়ে গলায় তলোয়ার ধরে রাখবেন। কিন্তু তার বদলে মসজিদের লোকজন ম্যাককিনির কাছে আসেন। সুকৌশলে তাকে নিরস্ত্র করেন। এরপর সবার জীবন রক্ষা পায়।
এই তথ্যচিত্রের পরিচালক জশুয়া সেফটেল ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি বলেন, ম্যাককিনির গল্প বেছে নেওয়ার পেছনে তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ভূমিকা রেখেছে। নিউইয়র্কের স্কানেকটেডি কাউন্টিতে শৈশব কেটেছে সেফটেলের। সময়টা ছিল ১৯৭০ সালের শেষ ও ১৯৮০-এর দশকে শুরুতে। সহপাঠীরা ওই সময় তার উদ্দেশ্যে ইহুদি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলত।
সেফটেল অনলাইন ভিডিও সিরিজ ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব মুসলিমস’-এর অংশ হিসেবে ওই তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। তিনি বলেন, ম্যাককিনির গল্পের মাধ্যমে তিনি সমাজে বৈষম্য ও বিভেদ দূর করার ব্যাপারে আশাবাদী।
সেফটেল বলেন, ম্যাককিনি ও মানসি ইসলামিক সেন্টারের সদস্যরা একে অন্যের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরির অসম্ভব কাজটি করতে পেরেছিলেন। এই সেতুবন্ধ তৈরি করা সম্ভব হলে সবকিছু করা সম্ভব। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে আমরা বিভেদ দূর করে এক হতে পারি।
‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’ তথ্যচিত্রে ম্যাককিনির বদলে যাওয়ার পুরো কাহিনি এখানে তুলে না ধরাই ভালো। তবে এই তথ্যচিত্রের নাড়া দেওয়া কিছু দৃশ্য ও চরিত্রের গল্প এখানে না বললেই নয়।
যুদ্ধে গিয়ে ম্যাককিনি কীভাবে বদলে গিয়েছিলেন, সে গল্প বলা যাক। ২০০৬ সালে মানসিতে ফেরার পর ম্যাককিনির মাথায় একটা জিনিসই ঘুরত আর তা হলো, যুদ্ধের সময় কোনো সেনা অক্ষত ছিলেন না।
ম্যাককিনি বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তিনি ইরাকি ও তালেবান সেনাদের মানুষ হিসেবে নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে দেখতে শিখেছিলেন। তিনি বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতে শিখেছিলেন। বাড়ি ফেরার পর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ভুলতে তিনি মদ্যপান করতেন।
ম্যাককিনি তার জীবনের সব কষ্টকর অভিজ্ঞতার জন্য মুসলিমদের দায়ী করেছিলেন। নিজের এলাকা মানসিতে ফিরে মুসলিমদের দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ, তার মনে হয়েছিল, ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ নিয়ে মুসলিমরা উপহাস করে।
ম্যাককিনি বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের দেশ মনে করি। আমি দেশের জন্য রক্ত ঝরিয়েছি। কিন্তু মানসিতে ফিরে মনে হয়েছিল, আমি এখানকার কেউ নই।’
যুদ্ধের সময় মানুষকে হত্যার জন্যও নিজেকে দোষী ভাবতেন ম্যাককিনি। তিনি আসলে কেবল মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছেন নিজের সঙ্গেও।
‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’-এ ম্যাককিনির সাবেক একজন স্ত্রীকে তাই বলতে শোনা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যা করেছেন, সে জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি ম্যাককিনি। তার ক্ষোভ উসকে দেওয়ার মতো অনেক লোক মানসিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন জোমো উইলিয়ামস।
এই উইলিয়ামস ইসলামিক সেন্টারের আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মার্কিন। তারও এমন বিদ্বেষের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার পূর্বসূরিদের একজনকে শ্বেতাঙ্গরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল। এর পর থেকে তিনি শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন।
উত্তেজিত অবস্থায় ম্যাককিনিকে প্রথম মসজিদে ঢুকতে দেখেছিলেন উইলিয়ামস। ম্যাককিনিকে দেখেই তিনি বুঝেছিলেন, কিছু একটা গোলমাল আছে।
তবে ‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’-এ যদি কাউকে নায়িকা বলতে হয়, তাহলে তিনি ‘সিস্টার বিবি’। ইসলামিক সেন্টার অব মানসির সহপ্রতিষ্ঠাতা বিবি বাহরামি। বাহরামি ও তার স্বামী মোহাম্মদের জোরালো ভূমিকা রয়েছে সেন্টারে।
বাহরামি স্থানীয় নারীদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবী। ওয়াইডব্লিউসিএ, মানসি রোটারি ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও স্থানীয় ব্যক্তিদের ফেলোশিপের কাজও করেন তিনি। বাহরামি ইসলামিক সেন্টারের ওয়েবসাইটে পবিত্র কোরআনের আয়াত লিখে রেখেছিলেন। আর সেটা ছিল, ‘ভালো কাজের প্রতিদান কল্যাণ ছাড়া আর কিছু নয়।’
বিবি বাহরামিও জানতেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। আফগানিস্তানে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সময় তার পরিবার গৃহহীন হয়। নিজ দেশ ছেড়ে ছয় বছর পাকিস্তানের শরণার্থীশিবিরে থাকতে হয় তাকে। এরপর তার বিয়ে হয়। পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
মানসিতে বাহরামিকে সেফটেল ডাকতেন মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘মাদার তেরেসা’ নামে। তিনি সেখানে আসা অপরিচিত অতিথিদের কাপড় পরিষ্কার করতেন। খাবারের বন্দোবস্ত করতেন। এমনকি অন্য দেশের উদ্বাস্তুরাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন বিবি বাহরামি। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি নিজের ধর্ম পালন করতে পারছেন। হিজাব পরতে পারছেন। শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভালোবাসেন।
বিবি বাহরামি মনে করেন ‘সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন একে অন্যের যত্ন নেওয়ার জন্য। একে অন্যের সঙ্গে বিবাদের জন্য নয়।’
ম্যাককিনি যখন মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন অনেকেই ভেতরে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। তবে ম্যাককিনিকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান বাহরামি। তিনি তার জন্য মুরগি, ভাত, বেগুন, লেবুর শরবতসহ নানা পদের খাবার তৈরি করে নৈশভোজের আয়োজন করেন। সবই গোগ্রাসে খান ম্যাককিনি।
এই খাবার খেতে ম্যাককিনি প্রায়ই আসতে থাকেন। বাহরামি ও সেন্টারের অন্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি পবিত্র কোরআন পড়েন। বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে মসজিদের বাকিদের সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে ওঠে।
মসজিদে প্রথম দিন হামলার উদ্দেশ্যে আসার আট মাস পর ম্যাককিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এমনকি তিনি দুই বছর ইসলামিক সেন্টারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মানসি সেন্টারের সবার উদারতায় মুগ্ধ হয়েছেন ম্যাককিনি। তিনি বলেন, ‘তারা সবাই সুখী। আমার জীবনে এটি দরকার। যদি প্রথম দিন এই সেন্টারের মানুষ তাদের প্রতি সহিংস আচরণ করত, তাহলে সেখানে রক্তাক্ত পরিস্থিতি হতে পারত।’
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনা ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে ৫০০ শতাংশ বেড়েছিল।
ম্যাককিনি বলেন, যদি সেন্টারের মানুষদের আতিথেয়তা ও ভালোবাসা না পেতেন, তাহলে মসজিদে হামলা চালাতেন। মৃত্যুদণ্ডও হতো তার। ম্যাককিনি যে উদারতা ও ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটাই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তথ্যচিত্রের একটি অংশে দেখা যায়, উইলিয়ামের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাককিনি। তারা একসঙ্গে নামাজ আদায় করছেন। আর এ সময় মসজিদের ভেতরটা সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই ছবি মনে করিয়ে দেয়, ম্যাককিনি আর মসজিদের গেটে অপরিচিত কেউ নন।
ম্যাককিনি বলেন, তিনি ভাইবোনদের নতুন একটি দল খুঁজে পেয়েছেন। যুদ্ধের উত্তাপে নয়, বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
এসডব্লিউএসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ