শুধু ডলারের সংকট সামলানোই নয়; সরকার এবার খরচের টাকার টানাটানিতেও পড়েছে। রাজস্ব আদায়ে নাজুক অবস্থা। কৃচ্ছ্রসাধনে মেগা প্রকল্পের টাকা কাটছাঁট করেও অপচয় কমানো যাচ্ছে না।
নিত্য খরচ মেটাতে ব্যাংক থেকে বেড়েছে ধারকর্জ। টাকা ছাপিয়েও খরচ সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে। নির্বাচনের বছরে সবাইকে খুশি করার চাপের মধ্যেই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের ভেতর এখন রীতিমতো হিমশিম অবস্থা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) টাকা নেওয়ার পরও এখন নতুন করে বিশ্বব্যাংকের কাছে খরচের টাকার জন্য হাত পাততে হয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে সংস্থাটির কাছে ৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাংকও টাকা দিতে সায় দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। গত মঙ্গলবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) কাছে আমদানির দায় হিসেবে রিজার্ভ থেকে ১০৫ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.১৫ বিলিয়ন ডলারে। এ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের (প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন হিসাবে) আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। গত ১লা মার্চ রিজার্ভ ছিল ৩২.৩০ বিলিয়ন ডলার। ঠিক এক বছর আগে একই সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু ধার করে খরচ চালিয়ে গেলে চলবে না; বরং খরচ আর অপচয় না কমালে ঋণের টাকায় অর্থনীতিতে সুফল মিলবে না। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার নানা তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা, ইআরডি ও বিশ্বব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নির্বাচন বলেন আর যা-ই বলেন, সরকারের এখন হাত-পা বাঁধা। ফলে খরচ এমনভাবে কমাতে হবে, যাতে প্রয়োজনীয় ব্যয়গুলো চলবে, আবার অপচয় কমবে। বেতন-ভাতা কমাতে পারবেন না। কাটছাঁট করতে হবে উন্নয়ন বাজেট।
সেখানে এবার যে কাটছাঁট হয়েছে, সেটা গতানুগতিক। এবার যে বিশেষ পরিস্থিতি, এটা মাথায় নেওয়া হয়নি। ডলার খরচ নেই, এমন প্রকল্প রেখে দেশীয় টাকায় বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প রাখা উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি।
জানা যায়, এক বছর দেশ চালানোর জন্য চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয় সরকার। এ লক্ষ্যমাত্রা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি হারে রাজস্ব আদায় করার কথা এনবিআরের।
অথচ শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর মিলে জানুয়ারি মাসে মোট রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সাত মাসেই রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ডলার বাঁচাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় সবচেয়ে বেশি রাজস্ব ঘাটতি পড়েছে শুল্ক খাতে। সাত মাসে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
সুতরাং ডলারের সংকটের কারণে আমদানি কমায় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতার ঝুঁকি রয়েছে; তাতে এনবিআরের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তাই প্রকল্প খরচে কাটছাঁট করা হয়েছে। এরই মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমিয়ে আনা হয়েছে। কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমানো ও স্থগিত করা হয়েছে। বিশেষ করে সরকারের বহু কাঙ্ক্ষিত চলমান মেগা প্রকল্পগুলো থেকেও খরচের কিছু টাকা কমানো হয়েছে।
তবে এটাও যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। গতকাল তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এই বিশেষ অবস্থা মাথায় রেখে সরকারের খরচ করা উচিত।
রাজস্ব আয় হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগের সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে। ঋণের বোঝা বাড়ছে। আবার বাজেট সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এসবই তো চাপ।’
সামনে নির্বাচন। এ সময়ে সাধারণত খরচ বাড়ে। জনতুষ্টির নতুন নতুন প্রকল্পে খরচ বাড়ানো হয়। এর সঙ্গে প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে। পরিস্থিতির উন্নতি করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর।
তাই বেসরকারি খাতের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকার টিসিবির মাধ্যমে কয়েকটি নিত্যপণ্য নিজ ব্যবস্থাপনায় কিনে সুলভে বিক্রি শুরু করেছে। এ খাতে সরকারের বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। সামনে রমজান ঘিরেও বাজার পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ খাতে সরকারের খরচ আরও বাড়ার ঝুঁকি আছে।
একদিকে সরকারের কাঙ্ক্ষিত আয় নেই, অন্যদিকে খরচের বাড়তি চাপ। সব মিলিয়ে সরকার নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে ধারকর্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের ধারের বড় উৎস ব্যাংকব্যবস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা ধার করেছে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে সরকার ধার নিয়েছিল মাত্র ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
শুধু তা-ই নয়; তারল্য প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে ৫০ হাজার কোটি নগদ টাকাও ছেপেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সরকারের ঋণ নেওয়ার সুযোগ আরও অবারিত করতে সম্প্রতি ঋণের সীমাও বাড়ানো হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সরকার এখন ব্যাংকব্যবস্থা থেকে দৈনিক ১৬ হাজার কোটি টাকা নিতে পারবে। এর আগে এক দিনে সরকার সর্বোচ্চ নিতে পারত ৬ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতির হিসাব বলছে, ব্যাংক থেকে বেশি ধার করলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যায়। বেসরকারি খাত তখন কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা বাড়াতে পারে না। ফলে অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে পরিচিত বেসরকারি খাতের গতি স্লথ হয়ে যায়।
তখন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সার্বিক অর্থনীতির গতি স্লথ হয়ে পড়ে। যার পরিণামে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। সামনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ব্যাংক থেকে যাতে কম ধার করতে হয়, তাই এখন বিদেশি উৎসের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
আইএমএফ এরই মধ্যে সাড়ে ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি হিসাবে ৪৭ কোটি ডলার ছাড় করেছে। ওই টাকা এখন সরকার খরচ করছে। সামনে বাজেট বাস্তবায়নে আরও যে চাপ আসবে তা সামাল দিতে টাকা ধার চাওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। সংস্থাটির কাছে সাধারণত সরকার উন্নয়ন সহায়তা চায়। না পারতে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, সরকারের ব্যয়ের চাপ কমাতে বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও এ সংকটের সময়ে তা ধার দিতে রাজি হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক দুই কিস্তিতে এ টাকা দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু সরকার চাচ্ছে তা যেন এক কিস্তিতেই দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বিলাসী বাজেট দেওয়া হয়। তাতে ঘাটতি ধরা হয় ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে প্রকল্প কাটছাঁট করে তা সাড়ে ৫ শতাংশে ধরে রাখার চেষ্টা থাকলেও খরচে খুব একটা লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিভিন্ন খাতে অপচয়ও রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রয়োজনীয় তহবিলসংকটে সামনে বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। দক্ষতার সঙ্গে বাজেট ব্যবস্থাপনা করতে হবে। নাহলে, সরকারের ওপর প্রয়োজনীয় খরচের চাপও বাড়বে।
এসডব্লিউএসএস/১০২৫
আপনার মতামত জানানঃ