একটা গুহা। নিকষ কালো আদিম গুহা, পরতে পরতে রহস্য, কোন পাথরের স্তরের নিচে কী আছে জানার কোন উপায় নেই। প্রবেশের বিশালাকার মূল প্রবেশপথটি দেখলে মনে হয় ডাইনোসরদের আস্তানা। গুহাটি যে কত মিলিয়ন বছর প্রাচীন তাও জানা নেই।
এখানে মিলেছে তলোয়ার দেঁতো বাঘ, বিশালাকৃতির স্থলচর প্রাণী, নানা জাতের সরীসৃপ বিশেষ করে ডাইনোসরদের জীবাশ্ম। জীবাশ্মের রাজ্যে এই গুহা এক অনন্য প্রাকৃতিক সংগ্রহশালা এবং এখানেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে জীবাশ্মে পরিণত হওয়া আমাদের পূর্ব-পুরুষ হোমিনিডদের হাড়-গোড়, দেহাবশেষ।
হয়তোবা মানব সভ্যতার হাঁটি হাঁটি পায়ে চলা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই! স্টের্কফনটেইন নামের এ গুহার অবস্থান দক্ষিণ আফ্রিকায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার এককালের স্বর্ণশহর খ্যাত জোহান্সবার্গ থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের দূরত্বে অবস্থিত ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব সম্পদের মর্যাদা পাওয়া ‘ক্রেডল অফ হিউম্যান কাইন্ড’ বা সোজা বাংলায় যাকে বলা হয় মানব জাতির আঁতুড়ঘর! এখানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়ানো বেশ কটি গভীর গুহা, পরিখা, সমতল ভূমি- যার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া গেছে অমূল্য জীবাশ্ম সম্ভার, খোঁড়াখুঁড়ি চলছে আজো প্রতিনিয়ত।
এই এলাকার চুনাপাথরের খনিগুলোতে নানা প্রাণীর জীবাশ্মে পরিণত হওয়া দেহাবশেষের সন্ধান মিলতে থাকে ১৮৯০ থেকে। কিন্তু বিশ্বের সত্যানুসন্ধানীদের মনে চিরতরে স্থান করে নেয় স্টের্কফনটেইন গুহা ১৯৩৫ সালে, যখন এখানে প্রথম হোমিনিড (মানুষ ও অন্যান্য এপের মধ্যবর্তী পর্যায়, ‘নরবানর’ বলা যেতে পারে) জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয় অষ্ট্রেলিয়োপিথোকাস আফ্রিকানোস।
কয়েক মিলিয়ন বছরের পুরনো হলেও খুলি দেখে বোঝা যায় আধুনিক মানুষের কত কাছাকাছি ছিল তারা। বুদ্ধিমান মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় বড় করোটি, দুই পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা ইত্যাদি ছিল প্রায় আমাদের ধাচেরই, আর এর পরেই মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের পুরনো চুনাপাথরের নিচের স্তরগুলোতে ঘটতে থাকে একের পর এক চমক জাগানো আবিষ্কার।
জানা যায়, অনেক মিলিয়ন বছর আগে এটা ছিল ভূমি আর সমুদ্রের মিলনস্থান। এর প্রমাণ গুহার ভেতর পাওয়া যায়। আর সমুদ্র সরতে সরতে চলে গেছে এখন বহু হাজার মাইল দূরে। হয়ত তখন এখানে ছিল শিকারের সুব্যবস্থা, হয়তোবা জায়গাটি ছিল বন্যপ্রাণীর কবল থেকে অধিকতর নিরাপদ।
বিশাল গুহা মুখের সামনে চওড়া পথ হলেও ভিতরে তা ক্রমশই সরু হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় নির্ঘাত হামাগুড়ি দিতে হতে পারে, এতটাই সরু। কাজেই পিঠের বা পায়ের অসুখ থাকলে কেউ যেন এখনই জানিয়ে রাখে। শুরু হলো গুহার অভ্যন্তরে আমাদের যাত্রা। সবমিলিয়ে পঞ্চাশের উপরে দর্শনার্থী হবে। গ্রহের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছে আদিপুরুষের ঠিকুজি জানার অদম্য আশায়, মনের গহনে আশা দেখা যাক পূর্বপুরুষের আবাস।
বিশাল প্রবেশপথ থেকে পরিবর্তীতে তৈরি সিঁড়ি দিয়ে নামার শুরু, খানিক পরেই ঘুটঘুটে আঁধারের জয়জয়কার। দলের একমাত্র বৈদ্যুতিক বাতিটি গাইডের দখলে। সে দেখাতে লাগল চুনা পাথরের স্তর, ফোঁটা ফোঁটা চুনের পানি পড়ে হাজার বা লক্ষ বছরে তৈরি হওয়া ষ্ট্যালাকটাইট আর ষ্ট্যালাগমাইট, কোথাও ঘুপচি মেরে নিদ্রারত বাদুড়। এক পর্যায়ে প্রকৃতির হাতে তৈরি এক বিশাল হলঘরে দাঁড়ালাম সবাই, সেখানেই জোরালো টর্চের আলো দিয়ে গাইড দেখাল আদি সমুদ্রের ঢেউ আর তরঙ্গের তাণ্ডব পাথূরে দেয়ালেও অমর অক্ষয় হয়ে টিকে আছে এত মিলিয়ন বছর পরে।
প্রথমে তো নজরেই আসে না, আঁধারে চোখ সয়ে এলে আবছা ভাবে বোঝা যায় ধূসর দেয়ালে কেমন যেন অস্পষ্ট স্মৃতিচিহ্ন। বোঝা যায় ক্রমশ নিচের দিকে নেমেছে সেই আধোছায়া মেশানো দাগ। ষ্টেফান আফ্রিকানো ইংরেজিতে বয়ান করে যায়, ২০ মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্র এতটাই কাছে ছিল। তারপর বিভিন্ন ভৌগোলিক –প্রাকৃতিক কারণে লোনাপানির স্তর নামতে শুরু করে, লক্ষ লক্ষ বছরে তা সরে যায় বহু যোজন মাইল দূরে। হয়ত একারণেই আদিমানুষের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে এককালের নিরাপদ আশ্রয়টি!
ভেতরে রয়েছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। আঁধার গুহার একপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পানি। জানা যায়, এই পাতাল হ্রদের গভীরতা প্রায় ১৩৫ ফিট আর নিতান্তই সুমিষ্ট সুপেয় জল। এমনও হতে পারে আদি সাগরের জলই এখানে আটকা পড়ে এত লক্ষ বছরে লবণাক্ততা হারিয়ে পরিণত হয়েছে স্বাদুতে, নিশ্চয়ই এর গভীরে পাওয়া যাবে অমূল্য সব জীবাশ্ম সংগ্রহ। কিন্তু এক দুঃসাহসিক অভিযান চলাকালে এক ডুবুরীর এই পাতাল হ্রদে অকালমৃত্যুর কারণে এর রহস্যময় তলদেশ নিয়ে গবেষণায় খানিকটে ছেদ পড়েছে।
এর কিছু দূরে ১৯৯৭ সালে পাওয়া গিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়োপিথোকাস আফ্রিকানোসের এক পরিপূর্ণ কঙ্কাল। সেটি ছিল তেত্রিশ লক্ষ বছরের পুরনো এক শিশুর, যে কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছিল লিটল ফুট। সেখানে এখনো সমানে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি, পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক নানা প্রাণীর জীবাশ্মসহ আদি মানুষের সুপ্রাচীন প্রস্তরযুগের হাতিয়ার, যার সমস্ত সংগ্রহই রয়েছে স্থানীয় জাদুঘরে।
কেমন ছিল সেই গুহাবাসীদের জীবন? খুব একটা আলোকপাত করা যায় না এত সামান্য প্রমাণ থেকে। কিন্তু এর স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় দক্ষ, হয়ত এই কারণগুলোর জন্যই প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয় এড়িয়ে তারা টিকে গিয়েছিল এই গ্রহতে, গড়েছিল নব ইতিহাসের পত্তন।
এখানে উল্লেখ্য সেই স্টের্কফনটেইন গুহায় পাওয়া ৩৪ থেকে ৩৭ লক্ষ বছরের পুরনো হোমিনিড জীবাশ্ম। যার নাম মিসেস প্লেস (Mrs Ples)। যা কিনা তাঞ্জানিয়ায় পাওয়া সেই বিখ্যাত ফসিল লুসি’র চেয়েও ৫ লাখ বছর প্রাচীন! সমগ্র কঙ্কালটির বেশ অনেকখানিই উদ্ধার করা গেছে, করোটির কিছু অংশ আর নিচের চোয়ালসহ।
তা থেকেই কম্পিউটারে নানা মডেলের সাহায্যে তাদের যে চেহারাখানি আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি তাতে সামান্য কল্পনার মিশেল থাকলেও বলা চলে বাস্তব জীবনের প্রায় নিরানব্বই শতাংশ কাছাকাছি। ২০ থেকে ৪০ লক্ষ বছর আগে অষ্ট্রেলিয়োপিথোকাসরা আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা আমাদের অতি দূর সম্পর্কের আত্নার আত্মীয়।
তাদের থেকেই সময়ের সাথে, পরিবেশের তাগিদে ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তনে উদ্ভব হয় হোমো হাবিলিস, হোমো ইরেকটাস ও সবার শেষে আমাদের হোমো স্যাপিয়েন্সদের। কিন্তু এর মাঝে প্রকৃতিতে ঘটেছে আরেক ঘটনা। আমরা যেমন চিড়িয়াখানায় একসাথে নানা প্রজতির বানর, কুমির বা হরিণ দেখতে পাই, তেমনি বিশ্বজুড়ে একই সময়ে ছিল নানা প্রজাতির মানুষের আস্তানা।
আজ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে, সাগর সেঁচে আমরা কেবল ৫ প্রজাতির মানুষের কথা জানতে পেরেছি, যার একটি বাস করত বিচ্ছিন্নভাবে ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপে, বামন মানব গোত্র- হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত হোমো নিয়ান্ডারথাল বা নিয়ান্ডারথাল মানব, রাশিয়ায় পাওয়া ডেনিসোভান মানুষ, সম্প্রতি চীনে পাওয়া লংগী ম্যান বা ড্রাগন মানব এবং আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্সরা।
এর মাঝে প্রায় পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের পূর্বপুরুষরা মুখোমুখি হয় ইউরোপে, যার ফলাফল তাদের জন্য নিয়ে আসে বিলুপ্তি! জেনেটিকভাবে শতকরা নিরানব্বই ভাগেরও বেশী মিল থাকা এই জাতের মানুষদের সাথে নানা লড়াইয়ে লিপ্ত হয় ইউরোপে পদার্পণ করা প্রথম হোমো স্যাপিয়েন্সরা।
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলে আমাদের পূর্বপুরুষদের পেশীশক্তির প্রয়োগ ও হত্যাকাণ্ডের ফলেই বিলুপ্তির সম্মুখীন হয় তারা। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমান পৃথিবীতে আমরা যত ধরনের মানুসেরা বসবাস করি- কালো, সাদা, হলুদ, আমাজন বা পাপুয়ার আদিবাসী- সবাই কিন্তু এক জাতি- হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স! এবং আমাদের কোন প্রজাতি নাই।
এটা আজ প্রমাণিত যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল আফ্রিকার ঊষর প্রান্তর থেকে। তাই, দুই যুগ আগেও মানুষের উৎপত্তি এশিয়া না আফ্রিকা তাই নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও আজ সবাইই প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে মতৈক্যে পৌঁছেছেন আফ্রিকাই আমাদের সবার আদি মাতৃভূমি। এর আগে এশিয়ার চীনে ও জাভায় যে প্রাচীন মানবজীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে তা আফ্রিকা থেকেই কোন এক পর্যায়ে রওনা দেওয়া হোমো ইরেকটাসদের বন্ধুর পরিবেশে বিলুপ্ত হয়ে যাবার করুণ ইতিহাস। আর হোমো স্যাপিয়েন্সদের বসবাস মূলত ছিল পূর্ব আফ্রিকা, বর্তমান তাঞ্জানিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়ায়।
পরবর্তী ঘরগুলোর অন্যতম আকর্ষণ এই এলাকার বিভিন্ন গুহায় পাওয়া প্রস্তরযুগের অস্ত্র। আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও কতই না শৈল্পিক দক্ষতায় আর পরম মমতায় গড়া হয়েছিল এইসব জীবন রক্ষাকারী অস্ত্র। প্রায় সবগুলোই পশু শিকারের কাজে এবং শিকার পরবর্তী চামড়া খোলা ও মাংস কাটার কাজে ব্যবহারের জন্য। এইসব অস্ত্র দেখে ধারণা করা হয়, অন্তত দশ লক্ষ বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা আগুনের ব্যবহার জানত, হয়তোবা কেবল নিরাপত্তা বা উষ্ণতার জন্য বা অস্ত্র গড়ার কাজে। তবে খাবার আগুনে রান্নার প্রক্রিয়া শুরু হয় আরো বেশ পরে। আর সেখানে থেকে মোড় ঘুরে যায় মানব সভ্যতার। ঘটা শুরু করে একের পর এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।
আমাদের পূর্বপুরুষদের চোয়াল ছিল অনেক মোটা। বড় হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত, কাঁচা মাংস ছিড়ে খাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু আগুনে ঝলসানো নরম মাংস খাওয়ার ফলে অসুখ-বিসুখ তো কমলোই , আবার চোয়াল কয়েক প্রজন্ম পরে হয়ে এল অনেক ছোট হয়ে। সেই কারণে ভারসাম্য রক্ষার্থে মানুষের আগের চাপা কপাল হয়ে গেল সামনে দিকে অনেক বড় অর্থাৎ বড় মাথার খুলির অধিকারী হল মানুষ। ফলে মস্তিষ্কের আকার গেল অনেকখানি বেড়ে, বাড়ল বুদ্ধিমত্তা, যন্ত্র তৈরির ক্ষমতা, অজানাকে জানার ইচ্ছে। অবশেষে এই আফ্রিকা থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের ২০০ জনের এক ক্ষুদে দল রওনা দিল বাইরের বিশ্বে সত্তর হাজার বছর আগে, তাদেরই বংশধররা আজ সারা গ্রহের শাসনকর্তা রূপে প্রতিটি জায়গায় বিরাজমান।
এসডব্লিউএসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ