টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। সর্বাত্মক এই রুশ অভিযান মোকাবিলায় শুরু থেকেই ইউক্রেনকে অস্ত্রসহ সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে কিয়েভের পশ্চিমা মিত্ররা। এর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের শক্তিশালী দেশ জার্মানিও রয়েছে। আর জার্মানির এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশটির রাজধানী বার্লিনে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে এই বিক্ষোভের সমালোচনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি তাদের যে মিত্ররা ইউক্রেনে এখন সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে, জার্মানি তার অন্যতম।
এদিকে আলোচনা, উত্তেজনা নয়, এমনটিই দেখা গেছে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজনের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে, ভিড়ের মধ্যে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল—আমাদের যুদ্ধ নয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সামরিক উর্দি, রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা, রুশ সামরিক সংগীত ও ডানপন্থি প্রতীকের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে এক হাজার ৪০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।
তবে এদিনের বিক্ষোভে ডানপন্থি কোনো গোষ্ঠী অংশ নেয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের মুখপাত্র। বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি। এদিকে জার্মানির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডার বলেছেন, এ ধরনের বিক্ষোভের বিরোধিতা করা উচিত।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেনকে আরো অস্ত্র-সহায়তা দেওয়ার বিরুদ্ধে বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে হাজার হাজার জার্মান নাগরিক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। অস্ত্র দেওয়ার বদলে জার্মান সরকারের প্রতি সংঘাত নিরসনে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় সমাবেশ থেকে। খবর গার্ডিয়ান ও রয়টার্সের
বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলেছে, বার্লিনের বিক্ষোভে অন্তত ১০ হাজার মানুষ অংশ নেয়, তবে দ্য গার্ডিয়ান বার্লিন পুলিশের হিসাব উল্লেখ করে জানায়, এটা অন্তত ১৩ হাজার। শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবার্গ গেইটে ‘আপরাইজিং ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য বিদ্রোহ’ নামে বিক্ষোভ সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজক ছিলেন, জার্মানির বামপন্থী লিংকস পার্টির সদস্য সাহরা ওয়েগেনেখট এবং দীর্ঘদিনের নারীবাদী প্রচারণাকারী অ্যালিস শোয়ার্জার।
আয়োজকদের দাবি, অন্তত ৫০ হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। জার্মানির অন্যান্য শহরেও একইরকম বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ওয়েগেনেখট জার্মানিতে শান্তির পক্ষে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে এক নাগরিক প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, এখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালিনা বেয়ারবক তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসেও হয়েছে যুদ্ধ-বিরোধী সমাবেশ। তবে ভিন্ন ধাঁচে। বিক্ষোভকারীরা ইউক্রেনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে দেশটির জাতীয় সঙ্গীত গায়, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মিছিলে অংশ নেয় শিশুরা।
আপরাইজিং ফর পিস, বা শান্তির জন্য বিদ্রোহ নামক এই সমাবেশের মূল আয়োজক ছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক সাহরা ওয়েগেনেখট (মাঝখানে) এবং দীর্ঘদিনের নারীবাদী প্রচারণাকারী অ্যালিস শোয়ার্জার (ডানে)। ছবি: গেটি ইমেজেস/ আনাদলু এজেন্সি
বার্লিনের বিক্ষোভকারীদের হাতে যুদ্ধ-বিরোধী বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন দেখা যায়। এমন একটি ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আজ হেলমেট, কাল ট্যাংক, এরপর আপনার সন্তানকে (দিতে বলবে)’।
এর মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যুদ্ধ নিয়ে জার্মান সরকারের নীতি পরিবর্তনের ঘটনা। যেমন শুরুতে অস্ত্র সহায়তা দিতে আগ্রহী ছিল না বার্লিন। শুধু ৫ হাজার হেলমেট দেওয়ার প্রস্তাব দেয় ইউক্রেনকে। এ ঘটনায় ব্যাপক ক্ষুদ্ধ হয় ন্যাটো জোটের মিত্ররা। কূটনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে জার্মানি এখন ইউক্রেনে তাদের অত্যাধুনিক লেপার্ড-২ ট্যাংক রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের শঙ্কা এরপর জার্মান সেনাদেরও হয়তো একদিন পাঠানো হবে ইউক্রেনে।
‘ডিপ্লোম্যাটেন স্ট্যাট গ্রানাটেন’- অর্থাৎ ‘গ্রেনেডের বদলে কূটনীতিক পাঠান’; ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ কর’; ‘এ যুদ্ধ আমার নয়, এ সরকার আমার নয়’ এমন কিছু ব্যানারও দৃষ্টি কাড়ে।
বিক্ষোভে অংশ নেন নরবার্ট নামের সাবেক এক জার্মান সেনা। পুরো নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমরা সবাই যেন এ যুদ্ধ ও যুদ্ধবাজদের দাস’। তার হাতে ধরা ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আসল শত্রুরা থাকে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতোন শহরে’।
যুদ্ধের পেছনে বিশ্বের আর্থিক কেন্দ্র দুটির হাত রয়েছে এবং তারা যুদ্ধের অন্ত চায় না বলে দাবি করেন নরবার্ট। তার মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির আরেকটি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কোনো ন্যায্যতা নেই।
সমাবেশস্থল জুড়ে লাউডস্পিকারে বাজানো হয়েছে জন লেননের ‘ইমাজিন’ এবং নেনার ‘নাইনটি নাইন রেড বেলুন’- এর মতো বিশ্ব শান্তির পক্ষে গাওয়া গান।
এডিথ নামক এক নারীকে ভারতের অহিংস বিপ্লবী ‘মহাত্মা গান্ধীর’ বড় একটি পোট্রেট হাতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘এই উন্মাদনা থামাতে আমাদের গান্ধীর অহিংস বিরোধীতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত’।
বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ ইউক্রেনকে সমর্থন করা ব্যানারও বহন করেছেন, যেগুলোতে লেখা ছিল– ‘পুতিনের যুদ্ধ থামাও; ‘ইউক্রেনকে আত্মরক্ষায় সাহায্য দিন’।
ইউক্রেনের স্বেচ্ছাসেবী জরুরি চিকিৎসাদাতা সেনা ব্যাটালিয়নের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য নিয়ে ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট’ নামক একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ইউক্রেনীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ইয়েভহেন তিতারেঙ্কো। তিনি সমাবেশকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা বলছেন তারা শান্তিবাদী। আমিও শান্তিবাদী।
কিন্তু, একবার ভাবুন শত্রু আপনার বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকতে চাইছে। তখনও কী আপনি নিশ্চুপ থাকবেন? কারণ আপনি যদি পাল্টা গুলি না ছোঁড়েন, তাহলে তারা আপনাকে হত্যা করবে, আপনার সব সম্পদ লুঠ করবে, আপনার স্ত্রীকে ধর্ষণ, আপনার সন্তানদের হত্যা করবে। মানসিকভাবে অসুস্থ এক বৃদ্ধের (পুতিনকে ইঙ্গিত করে) সাথে সমঝোতা করতে যাওয়া নিরর্থক’।
জার্মানিকে এই যুদ্ধে আরো জড়িয়ে ফেলার জন্য জার্মান সরকারের যে সদস্যকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় সমাবেশে, তিনি হলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালিনা বেয়ারবক। সাহরা ওয়েগেনেখটের ভাষণ শেষে ক্ষুদ্ধ বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন, ‘বেয়ারবক রাউস’ বা বেয়ারবক চলে যাও।
জার্মানির কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট বুন্দেসটাগের প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান মারি অ্যাগনেস স্ট্র্যাক জিমারম্যান সরকারের ওপর ইউক্রেনের ওপর আরো বেশি সহায়তা দেওয়ার চাপ তৈরি করছেন। এজন্য তারও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
ওয়েগেনেখট বলেন, তার প্রধান উদ্দেশ্য ‘ইউক্রেনের মানুষের চূড়ান্ত দুর্ভোগ ও প্রাণহানি’র সমাপ্তি টানা। আর সেজন্যই ‘নিত্যনতুন সব অস্ত্র দিয়ে অনন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বদলে’ রাশিয়াকে আলোচনার প্রস্তাব দিতে হবে।
তার মতে, বর্তমান সংঘাতের কারণে তার মনে ১৯৮০’র দশকের পারমাণবিক যুদ্ধের শৈশবের ভয় ফিরে এসেছে। ইউরোপ এবং সর্বোপরি পৃথিবীজুড়ে এই যুদ্ধ বিস্তারের ভয়াল হুমকি দেখা দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সমাবেশস্থলে বার্লিন পুলিশের ১,৪০০ কর্মকর্তাকে মোতায়েন করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, সমাবেশে কেউ সামরিক পোশাক পরে বা সোভিয়েত বা রাশিয়ার পতাকা নিয়ে আসতে পারবে না, বা উগ্র ডানপন্থী কোনো চিহ্ন ব্যবহার করতে পারবে না- এমন নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরপূর্তির একদিন পরই জার্মানির বামপন্থী রাজনীতিবিদ ওয়েগেনেখট এটি আয়োজন করেন।
আয়োজকদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে সংঘাতকে উস্কে না দিতে আমরা জার্মান চ্যান্সেলরের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ প্রতিদিন এক হাজারের বেশি জীবন ঝরে যাচ্ছে, এই সংঘাত আমাদের নিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে’।
এসডব্লিউএসএস/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ