বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের আবাস প্রথমে আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে সীমাবদ্ধ ছিল। সেখানে লাখখানেক বছর থাকার পর ধীরে ধীরে এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
সে সময় তো আর গাড়িঘোড়া ছিল না। হেঁটেই চলতে হতো। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল? আর কত দিনইবা লেগেছিল? আফ্রিকা থেকে কেনইবা মানুষ হাঁটা ধরল অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে?
মাত্র ৪০ বছর আগে উত্তরা, বসুন্ধরা, বাসাবো, খিলগাঁও এসব এলাকায় কোনো মানুষ ছিল না, অধিকাংশ এলাকা ছিল বিল, পানির নিচে। মাত্র ৩০০ বছর আগে কলকাতা মেগা সিটিতে তেমন লোকালয় ছিল না। আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি, ৫০ বছর আগে ছিল সাড়ে সাত কোটি, এভাবে যদি পেছাতে থাকি, পাওয়া যাবে একসময় ঢাকা শহরেও কেউ ছিল না, আরও আগের কোনো একসময় বাংলাদেশেই কোনো মানুষ ছিল না। তারও আগে হয়তো ভারতবর্ষে ছিল না।
মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মানে একসময় হয়তো ১০০০০ মানুষ ছিল এবং কোনো সন্দেহ নেই ১০০০০ মানুষের পক্ষে পৃথিবীর লক্ষ লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্ভব না। স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে আদি মানুষগুলো কোথায় ছিল?
এসব প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। এখনো করছেন। বিভিন্ন স্থানে মানুষের ফসিল বিশ্লেষণ করে অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ বছর লেগেছে। অবশ্য বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত মানুষের দল একটানা কখনো হেঁটে চলেনি।
হয়তো সুবিধাজনক কোনো স্থানে কয়েক শ বা কয়েক হাজার বছর থেকে তাদের এক দল আবার স্থানান্তর হতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে অন্য কোনো স্থানে গিয়ে হয়তো আবার কয়েক হাজার বছর বসবাস করে। এভাবেই সারা বিশ্বে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে। আজ তো বিশ্বের আনাচকানাচে মানুষ পৌঁছে গেছে।
নতুন একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আধুনিক মানব মস্তিষ্কের বিকাশ প্রায় ১.৭ মিলিয়ন বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল। সেই যুগে আফ্রিকায় বসবাসকারী আদিম মানুষ পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।
তারপর তারা পূর্ব আফ্রিকা ছেড়া কিছু সময় পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলে যায়।
আদিম মানুষদের অনেক তথ্যই এখনও অজানা। বিজ্ঞানীরা সেই সব কিছুর সন্ধান করছেন। অবশিষ্ট অজানা দিকগুলিকে জানার চেষ্টা করছেন। তাই মানুষের বিকাশ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন তারা।
নতুন একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আধুনিক মানব মস্তিষ্কের বিকাশ প্রায় ১.৭ মিলিয়ন বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল। সেই যুগে আফ্রিকায় বসবাসকারী আদিম মানুষ পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।
তারপর তারা পূর্ব আফ্রিকা ছেড়ে কিছু সময় পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলে যায়। তবে এখন প্রশ্ন জাগে যে, প্রথম আদিম মানুষ কারা এবং কীভাবে তারা এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেয়েছেন।
গত ১০ লাখ বছরের মানব উন্নয়নের গবেষণায় (Study Of Human Development) দেখা গিয়েছে, চার প্রজাতির মানুষ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক মানুষ যেমন- হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস আর ভারতীয় পূর্বপুরুষদের অন্যতম হোমো হাইডেলবার্গেনসিস এবং হোমো ইরেক্টাস।
বিজ্ঞানীদের মতে, হোমো ইরেক্টাস, যা আফ্রিকায় বিকশিত হয়েছিল, তিনিই প্রথম মানুষ। প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকাতে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছিল। হোমো ইরেক্টাস তাদের থেকেই বিবর্তিত হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ ‘সৎ মানুষ’। হোমো ইরেক্টাস মানুষের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি। এই প্রজাতিটি ১৯ লক্ষ বছর আগে থেকে ১.৩৫ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, হোমো এরগাস্টার বা আফ্রিকান হোমো ইরেক্টাসই হতে পারে আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়া প্রথম মানব প্রজাতি।
জীবাশ্মের অবশেষ থেকে বোঝা যায় যে, এই প্রজাতিটি ১.৭৫ মিলিয়ন বছর আগে দক্ষিণ ইউরেশিয়ায় এর পরিসর প্রসারিত করেছিল। প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে, হোমো ইরেক্টাস আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় লেভানটাইন করিডোর এবং হর্ন অফ আফ্রিকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
জেনেটিক গবেষণার মাধ্য়মে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় ৭০,০০০ থেকে ৫৫,০০০ বছর আগে গিয়েছিল।
তবে এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে কেন আদি মানুষ আফ্রিকা ছেড়েছিল? মানব উন্নয়নের (Human Development) অনেক গবেষণায় দেখা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আদিম মানুষকে আফ্রিকা ছেড়ে ইউরেশিয়ার দিকে যেতে হয়েছিল। আফ্রিকায় খরার কারণে সেখানে অনাহার সৃষ্টি হয়েছিল।
আর সেই কারণেই তারা আফ্রিকা ছেড়ে ইউরেশিয়ার দিকে যেতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মধ্যপ্রাচ্যের জলবায়ু ও সবুজায়ন আফ্রিকা থেকে মানুষকে তাড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৬০,০০০ বছর আগে মানুষ আফ্রিকার বাইরে চলে গিয়েছিল কারণ জলবায়ু আর্দ্র থেকে খুব শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। সেই শুষ্ক পরিবেশে তারা মানিয়ে নিতে পারেনি।
তবে এই স্থানান্তর ছিল অনেক বেশি ধীর। সম্প্রতি কোরা ডাইজেস্ট ওয়েব পেজে এ বিষয়ে জন নারসে চমৎকার একটি বিবরণ দিয়েছেন। তিনি একাধারে প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। একটি হিসাব বের করে তিনি দেখিয়েছেন, আফ্রিকা থেকে রেড সি ঘুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তর চলেছে প্রায় ৩০ হাজার বছর। মোট পথ পরিভ্রমণ করেছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার। তাই এক হিসাবে বলা যায়, এই স্থানান্তরের গতি ছিল গড়ে বছরে মাত্র এক কিলোমিটারের চার ভাগের এক ভাগ।
অর্থাৎ, ধরুন কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট! এই পিঁপড়ার গতিতে মানুষ লাখ লাখ বছর ধরে বৈশ্বিক অভিবাসন করেছে। আসলে মানুষ কিছু দূর যাওয়ার পর সেখানে হয়তো কয়েক শ বছর থেকেছে। তারপর আবার কোনো দুর্যোগের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে।
এটা বিস্ময়কর যে মানুষ লাখ লাখ বছর ধরে হেঁটে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ, যেভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, এখন মানুষ কোথায় যাবে? আদি যুগে তো মানুষ এক মহাদেশ পার হয়ে অনুকূল কোনো মহাদেশে আস্তানা গেড়েছে। কিন্তু বিশ্বে তো আর কোনো স্থানান্তরের উপায় নেই। অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীরা এখনো দেখছেন না। এ পৃথিবীতেই আমাদের থাকতে হবে। পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই কেবল মানুষ বাঁচবে। এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য মানুষের প্রচেষ্টার উপরই নির্ভর করবে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের টিকে থাকা বা না থাকা। মানুষকে কী পারবে?
এসডব্লিউএসএস/২০১৫
আপনার মতামত জানানঃ