দেশে আমদানি নির্ভরতার ওপর এককভাবে জোর দিতে গিয়ে স্থানীয় গ্যাস খাতের প্রতি অবহেলা করা হয়েছে। গত দুই দশকে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে বড় বিনিয়োগ হয়নি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে জ্বালানি বিভাগকে।
সূত্র মতে, ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল—এ সময়ের গ্যাস খাতের উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন বিভাগ। এতে ভূতাত্ত্বিক জরিপ, গ্যাসকূপ খনন, উন্নয়ন ও রিগ কেনাসহ সাত ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগামী আট বছরে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদ্যমান বাজার বিবেচনায় ব্যয় হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক শূন্য ৯ কোটি ডলার।
অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে জ্বালানি বিভাগ। চলতি অর্থবছরের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাব বিবেচনায় নিলে আগামী আট অর্থবছরে ব্যয় হবে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা, ডলারের হিসাবে ২১ বিলিয়ন। এলএনজি আমদানি ব্যয়ের তুলনায় স্থানীয় এ বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে অদূরদর্শী বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা।
গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে নেই বড় বিনিয়োগ
দেশে ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাসের মজুদ কমে আসায় এ খাতের উন্নয়নে সরকার ২০৪১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিন ধাপের এ পরিকল্পনা ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি ধাপের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে পেট্রোবাংলা।
তাতে দেখা গেছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত আগামী আট বছরে দেশের সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত এলাকায় গ্যাস মজুদ নির্ধারণের জন্য ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া টুডি, থ্রিডি, গ্যাসের অনুসন্ধান কূপ, সংস্কার, ওয়ার্কওভারসহ রিগ ক্রয়ের মতো পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন বিভাগের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে, দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নের অংশ হিসেবে ১ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার জিওলজিক্যাল সার্ভে করবে জ্বালানি বিভাগ। বাপেক্সের দেয়া হিসাব অনুযায়ী এ প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৩০ কোটি টাকা।
প্রতি লাইন কিলোমিটার ২ লাখ টাকা হিসাব করে এ অর্থ ব্যয় হবে। এছাড়া পাঁচ হাজার লাইন কিলোমিটার টুডি সিসমিক সার্ভে করা হবে। তাতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ১৫০ কোটি টাকা (প্রতি লাইন কিলোমিটার ৩ লাখ টাকা), ২ হাজার কিলোমিটার থ্রিডি সিসমিক সার্ভে ১৮০ কোটি টাকা (প্রতি বর্গকিলোমিটার লাইন ৯ লাখ টাকা), ১৩টি অনুসন্ধান কূপে সম্ভাব্য ব্যয় হতে পারে ১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, ছয়টি উন্নয়ন কূপে ৬০০ কোটি টাকা, প্রসেস প্লান্ট স্থাপনে (৬০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার হিসাবে) ১৫০ কোটি টাকা এবং তিনটি রিগ ক্রয়ে গড়ে ৪০০ কোটি টাকা হিসাব করে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা (২ হাজার হর্স পাওয়ার রিগের হিসাব ধরে)।
সব মিলিয়ে আগামী আট বছরে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তাতে ব্যয় হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স দিয়ে এসব কাজ করলে এ পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। তবে বিদেশী কোনো কোম্পানি বা আইওসি দিয়ে এসব কাজ করানো হলে এ অর্থ বড় জোর ২ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে।
স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও এ খাতের সংস্কারে এ অর্থ অতিসামান্য বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘গ্যাসের দ্রুত সরবরাহ ও আরো বড় পরিসরে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কারে অফশোর ও অনশোর এলাকায় আরো বেশি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তাতে বড় আকারে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম বলেন, দেশের গ্যাস খাতের অনুসন্ধানে অনেক বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাতে অনুসন্ধান তত্পরতা যেমন বাড়বে, তেমনি জরিপ, অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার এলাকা এবং স্থানীয় গ্যাস কোম্পানির কার্যক্রম আরো বড় হবে। তাতে দ্রুত ফলাফল পাওয়া যাবে।
স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে গত বছর যে পরিমাণ তৎপরতা দেখা গেছে, এ তৎপরতা গত এক দশক আগে হলে গ্যাসের এ সংকট এড়ানো যেত। এককভাবে আমদানিনির্ভরতায় জোর দিতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ এলএনজির পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। তাতে সংকট কাটেনি বরং বেড়েছে।
দেশে জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক ৩৭০-৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে। দীর্ঘমেয়াদি দুটি উৎস কাতার ও ওমান থেকে এ গ্যাস আমদানি করে গ্রিডে সরবরাহ দিচ্ছে পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)।
বিপুল আমদানি ব্যয়
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি ব্যয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে গত বছরের আগস্টে একটি চিঠি দিয়েছিল পেট্রোবাংলা। দুটি দেশ থেকে ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানি ব্যয়, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ খরচ ধরা হয়েছিল ২৭ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। সেই সময়ে প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা ধরে এ অর্থের কথা জানিয়েছিল পেট্রোবাংলা।
তবে বিদ্যমান ডলারের রেট হিসাব করলে এ অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে পেট্রোবাংলাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দৈনিক গড়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির এলএনজি আমদানির ব্যয় হিসাব করলেই গত আট অর্থবছরে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে কার্গো কম-বেশি হলে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানিতে সংশ্লিষ্ট সময়ে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ কোটি টাকার মতো ব্যয় হতে পারে।
পেট্রোবাংলার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে যে হারে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে তাতে দ্রুত গ্যাস সরবরাহে এলএনজি আমদানির বিকল্প নেই। স্থানীয় উৎস থেকে বৃহৎ কোনো গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে না, সরবরাহ খুব বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে স্পট থেকে হোক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি আরো বৃহৎ চুক্তিতে হোক গ্যাস আমদানির বিকল্প নেই।
আরপিজিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের জাতীয় গ্রিডে ২১ হাজার ৯৫৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরে দেশের জাতীয় গ্রিডে এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ৮৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি।
এসডব্লিউএসএস/১৬৫৮
আপনার মতামত জানানঃ