বেশি সুদের প্রস্তাব দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত পাচ্ছে না দেশের অনেক ব্যাংক। আবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (কলমানি) থেকেও চাহিদা অনুযায়ী অর্থের সংস্থান হচ্ছে না। বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ ধারের প্রধান মাধ্যম রেপোর সুদহারও। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহ ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ড বেড়েই চলছে।
যদিও ব্যাংকের আয়ের উৎস বা ঋণের সুদহার স্থির আছে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশেই। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলোই এখন দেশের ব্যাংক খাতের লাইফলাইন বা বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের তহবিল
মুদ্রাবাজারে তারল্যের জোগান বাড়াতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের পরিমাণ ও আকার বাড়িয়ে চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু গত ছয় মাসেই গঠন করা হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল।
এর মধ্যে রয়েছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) জন্য গঠিত ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল, ১০ হাজার কোটি টাকার রফতানি সহায়ক প্রাক-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএফ), রফতানিমুখী শিল্পের প্রি-শিপমেন্ট বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল, রফতানি ও উৎপাদনমুখী শিল্প খাতকে টেকসই করতে ৫ হাজার কোটি টাকার গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ও কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে এসব তহবিল গঠন করা হয়েছে। আরো নতুন তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গঠিত তহবিল থেকে দশমিক ৫০ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ সুদে অর্থ ধার নিতে পারছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সুদে গ্রাহকদের কাছে ঋণ পৌঁছানোর পরও কোনো কোনো তহবিলে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত স্প্রেড পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। নতুন তহবিলগুলো ছাড়াও কভিড-১৯ সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের সময় গঠিত প্রণোদনা তহবিল থেকেও ব্যাংকগুলো কম সুদে অর্থ ধার করতে পারছে।
যে বিপদে ব্যাংকগুলো
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করতে ব্যাংকগুলোকে এখন ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হচ্ছে। সংগৃহীত আমানতের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ১ থেকে ৩ শতাংশ তহবিল ব্যয়। সব মিলিয়ে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৯-১০ শতাংশে। যদিও ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে।
মুনাফা না হয়ে এ ধরনের বিনিয়োগে উল্টো মূলধন হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলোই অধিকতর লাভজনক। কোনো কোনো বিশেষ তহবিলে ৫ শতাংশ পর্যন্ত স্প্রেড পাওয়া যাচ্ছে। বিনিয়োগ সঠিক হলে ব্যাংকের মুনাফাও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও চাচ্ছে ব্যাংকগুলো পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে বেশি পরিমাণ অর্থ ধার নিক। এতে উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রসার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নিজেও চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় এমন মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ব্যাংকগুলোকে রেপোর মাধ্যমে ধার নেয়ায় নিরুৎসাহিত করছি। এজন্য রেপোর সুদহার বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এসব তহবিলের সুদহার অনেক কম। আমরা চাইছি, ব্যাংকগুলো বিশেষ তহবিলগুলো থেকে টাকা নিয়ে ঋণ বিতরণ করুক।’
তারল্য সংকটের এ সময়ে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলো ব্যাংক খাতের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুুবুর রহমান। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকে তারল্যের জোগান ও মুনাফার জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলো খুবই ভালো।
সঠিকভাবে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের অর্থ কাজে লাগাতে পারলে ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে। তারল্য সংকটের কারণে এখন আমানতের সুদহার ৭-৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে। এত উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব নয়। পুনঃঅর্থায়ন তহবিলগুলোর সুদহার খুবই কম। আবার কোনো কোনো তহবিলের স্প্রেড ৫ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। সবদিক থেকেই এ তহবিলগুলো লাভজনক।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল
দেশের সিএমএসএমইর জন্য গত বছরের ১৯ জুলাই ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বিশেষ এ তহবিল থেকে বার্ষিক ২ শতাংশ সুদে টাকা নিতে পারছে ব্যাংকগুলো। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ শতাংশ। সিএমএসএমই খাতের জন্য গঠিত এ তহবিলে ব্যাংকগুলে স্প্রেড পাচ্ছে ৫ শতাংশ।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থে গঠিত রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ওপর চাপ কমাতে সম্প্রতি দেশীয় মুদ্রায় একটি বিশেষ স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি গঠিত ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ এ তহবিলের নাম দেয়া হয়েছে ইএফপিএফ।
এ তহবিল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেড় শতাংশ সুদে অর্থ ধার নিতে পারবে। ধার নেয়া অর্থে রফতানিকারকদের সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। একজন রফতানিকারক সর্বনিম্ন ৫ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি বা স্থানীয় সংগ্রহের জন্য এ তহবিলের ঋণ ব্যবহূত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানিমুখী শিল্পের প্রি-শিপমেন্ট খাতের জন্যও ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। বিশেষ এ তহবিলের নাম দেয়া হয়েছে ‘প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’। এ তহবিল থেকে ব্যাংকগুলোকে অর্থ দেয়া হচ্ছে দশমিক ৫ শতাংশ সুদে।
আর গ্রাহক পর্যায়ে এ তহবিলের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। রফতানি ও উৎপাদনমুখী শিল্প খাতকে টেকসই করতে জিটিএফ নামে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর জন্য এ তহবিলের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ।
আর গ্রাহক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে সবুজ অর্থনীতির বিশেষ এ তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন। আবার জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়ন, পরিচালন ও বিকাশের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে।
দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি খাতের জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার। গত ১৭ নভেম্বর গঠিত এ তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো ধার নিতে পারছে মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সর্বোচ্চ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ শতাংশ।
ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কে কৃষকদের মধ্যে এ ঋণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ধান, মত্স্য, শাকসবজি, ফল-ফুল চাষের পাশাপাশি পোলট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদন খাতে বিশেষ এ তহবিলের ঋণ ব্যবহূত হবে। কৃষি খাতের জন্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ) নামে একটি তহবিলও গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো নিজেদের অর্জন না হওয়া অংশের সমপরিমাণ অর্থ বিশেষ এ তহবিলে জমা দেবে। এ তহবিল থেকে অন্য ব্যাংকগুলোকে ২ শতাংশ হারে অর্থ জোগান দেয়ার বিধান রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কভিড-১৯-এর অভিঘাত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যকে সুরক্ষা দিতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এসব প্যাকেজের মধ্যে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং এসএমই খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের তৃতীয় ধাপ এখনো বাস্তবায়নাধীন।
আবার রফতানি খাতকে সুরক্ষা দিতে ইডিএফের আকার ৩৫০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছিল। কভিডের সময় ঘোষিত আরো কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ এখনো চলমান রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এসডব্লিউএসএস১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ