বাংলাদেশে ৩০ বছর আগে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিন দশক ধরে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করছে। বাংলাদেশের মতো এমন উদাহরণ সৃষ্টিকারী দেশ বিশ্বে অনেক কম আছে।
প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু আজ সে সংখ্যা ১২–১৩ লাখ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানের জনসংখ্যা হলো আট লাখ। আমরা প্রায় দুটো ভুটানের সমান জনসংখ্যাকে রক্ষা করছি।
এর মধ্যে তথ্য উপাত্ত অনুসারে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত পাঁচ বছরে প্রায় আড়াই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। বিভিন্ন এনজিওর তথ্য বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১২৫ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
জানা গেছে, ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে শিশু প্রায় ছয় লাখ। এর মধ্যে আড়াই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে গত পাঁচ বছরে। ফলে জনগোষ্ঠী হিসেবে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অনিয়ন্ত্রিত শিশু জন্মদান ভাবিয়ে তুলছে স্থানীয়দের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনিয়ন্ত্রিত শিশু জন্মদান শুধু উদ্বেগই বাড়াচ্ছে না, এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হচ্ছে শঙ্কা।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে গড়ে ১২৫ শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে সাড়ে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একাধিক বিয়ে-বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়ছে।
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপ-পরিচালক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, আমরা ক্যাম্পগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিওর ৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী স্বল্প সময়ে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন। ঐ সময় আসা নারীদের মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই ক্যাম্পগুলোয় প্রচুর শিশুর জন্ম হয়।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। তবে কাজটা খুব কঠিন।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি চলছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এই হিসাবে ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে গত ৪ বছরে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে যোগ হয়েছে।
সরকারি হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা কত- জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশের কাছে ১১ লাখ রোহিঙ্গার একটি হিসাব রয়েছে। তবে ৩০ হাজার করে রোহিঙ্গা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে গত ৪ বছরে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে যোগ হয়েছে। তবে সেখানে নতুন করে কোনো শুমারি হয়নি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। আর এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে অক্টোবরে রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। এর আগে থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত–অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের কোনো ইচ্ছে নেই। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছে এবং সেটা তারা করেছে। তাদের বাধ্য করা না হলে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। আবার বাংলাদেশ একা তাদের বাধ্য করতে পারছে না। যারা এটা পারে, তারা করতে চায় না।
পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে, একটা সমস্যা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হয়, তারপর অন্য একটা সমস্যায় সেটা ঢাকা পড়ে। ফিলিস্তিন সমস্যা যেমন পৃথিবীর আড়ালে চলে গেছে, তেমনি রোহিঙ্গা সমস্যাও যদি আড়ালে চলে যায়, তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বললে তারা অনেক সমস্যার কথা বলে। কেউ আবার দুঃখ করে আত্মহত্যার কথা বলে। এ পৃথিবীতে কেউ কাউকে অধিকার দেয় না। এটা আদায় করে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের এই মানবাধিকার ধ্বংসের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আন্দোলন–সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। তারা তাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য এ কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে—তারা সমস্যার কথা বলার আগে তাদের যে ভূমিছাড়া করছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলন–সংগ্রাম করতে হবে।
অক্সফাম আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও দেশ পুনর্গঠনে সহযোগিতা করেছে। তাদের প্রশংসা করতেই হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার জন্য যা করা দরকার, সেটা করতে হবে। সেখানে তারা তাদের জীবন সুন্দরভাবে গড়ার চেষ্টা করবে। মনে রাখতে হবে, তারা আশ্রয় নিয়েছে, এটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা নয়।
এসডব্লিউএসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ