তেহরান শহরের আকাশে যখন ইসরায়েলের বোমারু বিমান ঘুরে বেড়ায়, তখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছায়ায় তেহরানবাসীর জীবন হয়ে উঠেছে অস্থির আর দুর্বিষহ। তেহরান ছেড়ে যাওয়ার সময় অনেক বাসিন্দা এক অদ্ভুত কিন্তু আবেগঘন কাজ করছেন—তাঁরা তাঁদের ঘরের শেষ ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করছেন। এই ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে সাজানো সোফা, টেবিলে গাছের টব, জানালায় পর্দা, আর সুটকেসে গুছিয়ে রাখা শেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ছবিগুলোর সঙ্গে লেখা থাকছে—“The last photo of home” বা “বাড়ির শেষ ছবি।”
এই প্রবণতা যেন এক নীরব বিদায়ের দলিল। কেউ লিখছেন, “গাছগুলিকে পানি দিয়ে রওনা হলাম। জানি না কোনোদিন আর ফিরে আসতে পারব কিনা।” কেউ আবার নিজের অফিস ডেস্ক, ল্যাপটপ আর হেডফোনের ছবি দিয়ে লিখছেন, “যেসব জিনিসের জন্য এত রাত জেগে পরিশ্রম করেছি, আজ সেগুলোকেই বিদায় জানালাম।” কেউ বলছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় আর ক্যারিয়ারের স্বপ্ন নিয়ে তেহরানে এসেছিলাম, আজ সেই শহর ছেড়ে যাচ্ছি জীবনের অনিশ্চয়তায়।”
তেহরান শহরে প্রায় এক কোটি মানুষের বসবাস। কিন্তু সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে রাজধানীটির উপর একের পর এক হামলা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র। ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৮ জন নিহত হয়েছেন। পাল্টা ইরানিও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, যাতে ইসরায়েলি শহরেও মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২৪ জনের। প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা আর সামরিক ঘাঁটি, কিন্তু হামলা ছড়িয়ে পড়েছে আবাসিক এলাকাতেও। রাজধানীর বাসিন্দারা তাই কেউ শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন, কেউ আবার সব ঝুঁকি সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তেহরানের উত্তরাঞ্চলের একটি বড় এলাকা খালি করার নির্দেশও এসেছে। তবু অনেকেই বলেছেন, “আমরা যাব কোথায়?” কারও পরিবারের সদস্যরা বৃদ্ধ বা অসুস্থ, কারও আছে ছোট শিশুসন্তান, কেউ আবার স্রেফ অর্থাভাবে বিকল্প ভাবতেই পারছেন না। একজন গর্ভবতী নারী বলেন, “সবকিছু ত্যাগ করে কোথায় যাব? যানজটের মধ্যে বেরিয়ে পড়া মানেই মৃত্যুর মুখে যাওয়া।” আরেকজন নারী বলেন, “আমার গাড়ি আছে, কিন্তু এত লম্বা পথে রওনা হয়ে যদি জ্বালানি না পাই, বা গাড়ি বিকল হয়, তখন কী করব?” যারা বেরিয়ে পড়েছেন, তারাও জানাচ্ছেন, স্বাভাবিকভাবে যেখানে ১২ ঘণ্টা লাগে সেখানে এখন ২০ ঘণ্টাও লেগে যাচ্ছে। বাসের টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে যারা থেকে যাচ্ছেন, তাদের কথায় ক্লান্তির ছাপ। দুই সন্তানের এক মা বলেন, “এত বছর ধরে পরিশ্রম করে যা গড়েছি, তা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমার সন্তানদের নিয়ে আমিও ধ্বংস হয়ে যেতে রাজি। নতুন করে আবার সব শুরু করার শক্তি আমার নেই।”
এই দুঃসময়ে শুধু ইরানের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরে থাকা কোটি কোটি প্রবাসী ইরানিও গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের ভরসা শুধু ইন্টারনেট, সেটিও অনিয়মিত। প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করেই। কেউ লিখছেন, “আমরা ভেবেছিলাম প্রবাসজীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিক হলো বাড়ির জন্য মন খারাপ করা। কিন্তু এখন বুঝছি—যুদ্ধকবলিত নিজের শহরের খবর না পাওয়া, আপনজনের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, এই ব্যথা আরও গভীর।”
বহু প্রবাসী চেষ্টা করেছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনকে শহর ছাড়তে বোঝাতে। কিন্তু অনেকেই সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছেন। এক প্রবাসীর আত্মীয় লিখেছেন, “কেউ অর্থের অভাবে, কেউ থাকার জায়গার অভাবে যেতে পারছে না। তাই আমাদের শহর ছাড়তে বলো না।”
এই পরিস্থিতি যেন এক সংগ্রামী জাতির সম্মিলিত মনখারাপের প্রতিচ্ছবি। সাজানো ঘরের ছবি, পরিপাটি সোফা, পর্দা টানা জানালা আর গাছের টব—সবই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে একটি জাতির হৃদয়ের টুকরো টুকরো বিদায়ের। কেউ নিশ্চিন্ত জানেন না ভবিষ্যতের ঠিকানা কোথায়। কিন্তু তারা জানেন—এই ছবিগুলোর ভেতরেই রয়ে গেছে তাঁদের ভালোবাসা, ইতিহাস আর জীবনের সবচেয়ে অমূল্য স্মৃতিগুলো।
আপনার মতামত জানানঃ