দক্ষিণ কোরিয়া সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে দ্রুত রূপান্তরিত হওয়ায় দেশটির নারীরা পিছিয়ে পড়েছেন। দেশটিতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের গড়ে এক-তৃতীয়াংশ কম বেতন দেওয়া হয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে অফিস পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন পুরুষেরা।
দেশটির সরকারি তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে নির্বাহী পদে আছেন মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। নারীরা ঘরকন্যার কাজ ও বাড়িতে শিশুর দেখভাল করবেন—এমনটাই এখনো ভাবা হয়। শুধু তা–ই নয়, এর সঙ্গে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। বিকাশমান প্রযুক্তিব্যবস্থার কারণে অনলাইনে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা বাড়ছে।
এসব সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিবর্তে দক্ষিণ কোরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল বলেছেন, কাঠামোগত যৌনতা ‘পুরোনো বিষয়’।
ইউন সুক-ইওলের ক্ষমতায় আসার পেছনে তরুণসমাজের অবদান অনেক। অথচ তরুণসমাজের এখন অভিযোগ, বৈষম্য কমানোর বদলে নতুন সরকারের দ্বারা তারা আরও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট ইউন সরকারি লিঙ্গ কোটা বাতিল করে ঘোষণা দিয়েছেন, এখন থেকে লিঙ্গভিত্তিতে নয়; বরং মেধার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। এ কারণে ১৯ সদস্যের মন্ত্রিসভায় তিনি মাত্র তিন নারী সদস্যকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তিনি দেশটির লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয় (জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি মিনিস্ট্রি) বাতিল করার চেষ্টা করছেন।
এই মন্ত্রণালয় নারী ও যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে। দেশটির আট শতাধিক প্রতিষ্ঠান সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একত্রিত হয়েছে। ওই সব সংগঠনের দাবি, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ায় অনলাইনে যৌন হয়রানির ঘটনা ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর ১১ হাজার ৫৬৮টি অনলাইন যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে ৮২ শতাংশ বেশি। অনেকেই গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। দেশটিতে নারীরা এখন শৌচাগারে যেতে ভয় পান বলে অভিযোগ আছে। তাদের অভিযোগ, শৌচাগারে গেলে গোপনে তাদের ছবি তোলা বা ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করা হতে পারে। এ ধরনের ছবি বা ভিডিও প্রকাশ পেলে তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। গভীর রাতে ভিনদেশি নারী একা হেঁটে গেলে যেমন ভয় পান, নিজ দেশে শৌচাগারে যেতে একই রকম ভয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং সফল ‘মি টু’ আন্দোলন হয়েছে। যেসব নারী ও পুরুষ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ‘#মি টু’দিয়ে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করে আন্দোলন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তরুণদের নেতৃত্বে নারীবিরোধী একটি ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই তরুণদের ধারণা ছিল, প্রতিযোগিতামূলক সমাজে নারীরা শীর্ষ স্থান দখল করে আছেন। কারণ, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক পরিসেবা সম্পন্ন করতে হয়। এ কারণে তাদের টানা দুই বছর অন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। দেশে নারীবাদী শব্দটিকে তারা অশালীন শব্দে পরিণত করতে সফল হয়েছেন। এসব কারণে কিছু নারী শব্দটি ব্যবহার করা নিয়ে বিব্রত, এমনকি কেউ কেউ ভয়ও পান।
লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয় বন্ধের সমর্থক ও নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে তরুণদের ভোট সংগ্রহে সহযোগিতা করা ৩৭ বছর বয়সী লি জুন-সিওক বলেন, ‘অতীতে নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের অনেক সমস্যার সমাধানও করা হয়েছে। লিঙ্গ সমতা এখন নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আমাদের একটি নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা নারীবাদের বাইরে দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করবে।’
লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয়ের জন্য সরকারের বাজেট মাত্র ০.২ শতাংশ। তবে নারীরা বলছেন, এই অল্প বাজেটেই তাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। ২০ বছর আগে এই মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার ও অন্তঃসত্ত্বা হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া নারীদের পক্ষে কাজ করেছে। এ ছাড়া এই মন্ত্রণালয় একা মায়েদের শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দিয়েছে।
ছয় বছর আগে নিজ কলেজের একজন অধ্যাপকের কাছে ধর্ষণের শিকার হন অ্যানা নামের একজন তরুণী। তিনি বলেছেন, মন্ত্রণালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। কারণ, এই মন্ত্রণালয় তার জীবন বাঁচিয়েছে। তিনি বলেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর বিষয়টি জানাতে তিনি বাবাকে ফোন করেছিলেন। বাবা সব শুনে ফোন কেটে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি পরিবারের জন্য লজ্জা বয়ে এনেছেন।
‘মি টু’ আন্দোলনের পর অ্যানা ধর্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পান। তিনি একটি সহায়তাকেন্দ্রে গিয়েছিলেন, কিন্তু সাহায্য করার আগে ওই কেন্দ্র ধর্ষণের প্রমাণ চেয়েছিল। তিনি চিকিৎসকের কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই চিকিৎসকও সহায়তা করেননি। এর কয়েক মাস পর তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
অ্যানা বলেন, ‘এটা খুবই হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমি বুঝতে পারিনি, কীভাবে সহায়তাকেন্দ্রের একজন চিকিৎসক হয়েও আমাকে সহায়তা করেননি। আমার মনে হয়েছিল, আমি একটি অন্ধকার ঘরে আটকা পড়েছি, যেখান থেকে বের হওয়ার পথ নেই।’
এর পরই লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেয়। মন্ত্রণালয় তাকে একটি সেফ হোমে রেখে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে এবং বিচারকাজে সহায়তা করে। পরে ওই অধ্যাপককে কারাগারে পাঠানো হয়। অ্যানা আরও বলেন, ‘আমি নিজের পরিবারের চেয়েও এই মন্ত্রণালয়ের কাছে অনেক বেশি সাহায্য পেয়েছি।’
দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বলছে, মন্ত্রণালয়ের চলমান সেবাগুলো অব্যাহত থাকবে। তবে এর অধীন অন্য বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। গত অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল বলেছিলেন, নতুন এ ব্যবস্থা নারীদের আরও সুরক্ষা দেবে। যদিও এ বিষয়ে তার যুক্তি অষ্পষ্ট ছিল।
তবে পার্লামেন্টে সব বিরোধী দল নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা এই পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন না-ও জানাতে পারেন। তাহলে হয়তো এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ ও শ্রমবাজার এমনভাবে গঠিত, যা লিঙ্গবৈষম্যকে স্থায়ী করে রাখে। এখনো দেশটিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর নারীদের চাকরি পেতে সংগ্রাম করতে হয়। এ কারণে প্রায় সময় তাদের অস্থায়ী ও কম বেতনের চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হতে হয়।
৫০ বছর বয়সী শিন হিউং-জাংয়ের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল। তিনি একটি স্কুলের প্রশাসক হিসেবে কাজ করতেন। সন্তান জন্মের পর তাকে স্কুল খোলা না থাকলেও শনিবারে অফিস করতে বলা হয়েছিল। এর অর্থ হলো ওই একদিন তিনি নিশ্চয়ই সন্তানকে ছেড়ে অফিস করতে যাবেন না। এমন পরিস্থিতিতে নিজে থেকেই তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এ ছাড়া তার স্বামীও সন্তানের দেখভাল করেন না। এ কারণে স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
শিন হিউং-জাং বলেন, ‘তিনি (স্বামী) একজন পুরুষতান্ত্রিক মানুষ। কোনো ব্যাপারেই সাহায্য করবেন না।’ গত ২০ বছর থেকে তিনি মানুষের বাসায় পানি পরিশোধন ও অন্যান্য সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ৪৬ শতাংশ নারী অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করেন, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩০।
শিনের টিমে দুজন কর্মচারী ছাড়া অন্য সবাই নারীকর্মী। তারা সবাই সন্তান জন্মের পর এই কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে ৩০ বছর বয়সী দুজন চলতি বছর কাজে যোগ দিয়েছেন। দুই দশক আগেও একই রকম পরিস্থিতি ছিল।
যেসব নারী ক্যারিয়ার সচেতন, কোনোভাবেই কাজ ছাড়া থাকবেন না, তাদের মধ্যে সন্তান না নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। দেশটিতে প্রজনন হার ০.৮১-এ নেমে এসেছে, যা বিশ্বে সবচেয়ে কম। এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ দেশটিতে জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। পূর্বাভাস সত্যি হলে দেশটির অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা ও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মানুষ পাওয়া যাবে না।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে দায়িত্বে থাকা লিঙ্গ সমতামন্ত্রী জিওং হিউন-বায়েক বলেন, ‘লিঙ্গ সমতা সমস্যার সমাধান না করে দক্ষিণ কোরিয়া জন্মহার–সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘মি টু আন্দোলনের কারণে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও বৈষম্য কিছুটা কমে এসেছে। এখন নারীদের বেতনের ব্যবধান ও সুযোগ বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, যে সরকার বিষয়টি স্বীকারই করে না, তারা তাহলে কীভাবে তার সমাধান করবে?
এ বিষয়ে বর্তমান লিঙ্গ সমতামন্ত্রী কিম হিউন-সুকের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে দেশটির সরকার তাতে রাজি হয়নি। পরে অন্য এক অনুষ্ঠানে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, দেশে কাঠামোগত যৌনতা নেই—প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত কি না। এ ছাড়া রাজনীতিতে আরও নারী নেতৃত্ব দরকার ও বেতন ব্যবধান কমানো উচিত কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
এসডব্লিউএসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ