বাংলাদেশে অনেকে রিমান্ড বলতেই বোঝেন পুলিশের নির্যাতন। অথচ বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রিমান্ডে শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলা হয়েছে, কোথাও মারধরের উল্লেখ নেই। আইনমন্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনায় রিমান্ডে নির্যাতন করার আলামত স্পষ্ট।
গতবছর একটি মামলায় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে রিমান্ডে নিজের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। নিরাপত্তার স্বার্থে এই ব্যক্তির নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে প্রথমে একটা ইন্টারোগেশন রুমে নেয়া হয়। প্রথমে তো অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমার শরীরের প্রতিটি জায়গায় আঘাত করেছে।
উল্লেখ্য, এই ব্যক্তিকে ওই মামলায় আদালতের মাধ্যমে দুই দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে থাকাকালীন পুরোটা সময় অমানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
“হাতের আঙ্গুলের এক পাশ দিয়ে মারত, ঘাড়ে হাড়ের নিচে, পায়ের পাতার নিচে মারত। প্রচুর নির্যাতনে আমি কয়েকবার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। বুকে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি দিয়েছিল, এখনও ব্যথা আছে।”
ছয় মাস পর তিনি মামলা থেকে খালাস পেলেও আজও নানা শারীরিক জটিলতা ও মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখনও আমি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছি। বিশেষ করে মানসিক ট্রমা হয়ে গেছে। ওই সময়টা আমি ভুলতে পারি না।
প্রসঙ্গত, রিমান্ডে নিয়ে আসামীদের ওপর নির্যাতনের এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র রিমান্ডে আসামীদের ওপর ১৪ ধরনের নির্যাতনের কথা জানতে পেরেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় উল্টো ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটানো, মুখে কাপড় ঠুসে পানি ঢালা বা ওয়াটার থেরাপি, ইলেকট্রিক শক দেয়া, হাত পায়ের আঙ্গুলে সুই ঢুকিয়ে নখ উপড়ে ফেলা। এর আগে মলদ্বারে ডিম বা মরিচ ঢুকিয়ে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে।
এ ধরনের নির্যাতনের মাধ্যমে আসামীর থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে নারায়ণগঞ্জে এক স্কুল ছাত্রী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় মেয়েটির বাবা মামলা করলে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে। মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।
পরে ২৩শে অগাস্ট মেয়েটি জীবিত অবস্থায় ফিরে এলে পুরো বিচারকাজ প্রশ্নের মুখে পড়ে।
রিমান্ডে নেয়ার কারণ
আইন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কিছু কারণ থাকতে হবে। সেগুলো হল:
১. যদি কোন মামলায় প্রকৃত আসামীর পরিচয় পাওয়া না যায় তাহলে ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা যায়।
২. কোন মামলায় একাধিক আসামী থাকলে, আটক একজনের থেকে বাকি আসামীদের সম্পর্কে তথ্য জানতে রিমান্ডে নেয়া যায়।
৩. ঘটনার ক্লু, ঘটনার বিবরণ বা অপরাধের উদ্দেশ্য জানতে রিমান্ডে নেয়া যায়।
সংবিধানে কী বলা আছে?
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ফৌজদারি কার্যবিধির অপপ্রয়োগই নয়, সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ‘ব্লাস্ট’।
সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে গ্রেফতার ও পুলিশ হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসেবে কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এই মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
১. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানানো।
২. আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে দেয়া।
৩. গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করা।
৪. ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া পুলিশ হেফাজতে আটক না রাখা।
৫. সকল প্রকার নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখা।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার
হাইকোর্টের রায়ে গ্রেফতারের সময় ও পরে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কিত নির্দেশনাসমূহ-
১. গ্রেফতারের সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলে আঘাতের কারণ লেখা এবং তাকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল বা সরকারি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে ডাক্তারের সনদ নেওয়া।
২. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দেওয়া।
৩. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নিকটতম ম্যাজিস্টেটের নিকট হাজির করা।
৪. ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্য কেন সঠিক তার বর্ণনা দেয়া।
রিমান্ডে আটককৃত ব্যক্তির অধিকার
হাইকোর্টের রায়ে রিমান্ডের আগে ও পরে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কিত নির্দেশনাসমূহ হলো-
১. তদন্তের প্রয়োজনে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এক পাশে কাঁচের দেওয়াল ও গ্রিল দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা, যাতে করে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবীরা জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দেখতে পারলেও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি শুনতে না পারেন। কাঁচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
২. রিমান্ড আবেদনে রিমান্ডে নেওয়ার বিস্তারিত কারণ লিপিবদ্ধ করা এবং কেস ডাইরি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করা। রিমান্ড আবেদনে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে কারণ লিপিবদ্ধ করে সর্বোচ্চ তিন দিনের রিমান্ডের নেওয়ার অনুমোদন দেয়া। তবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন যা সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে।
৩.গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে নেওয়ার পূর্বে ডাক্তারি পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করা। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তাহলে গ্রেফতারকৃতকে একই ডাক্তার বা মেডিকেল বোর্ডের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠানো।
৪. মেডিকেল রিপোর্টে পুলিশ হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তিকে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেলে কোন আবেদন ছাড়াই ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫. থানা বা পুলিশ হেফাজত বা জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা হেফাজতে নেয়া তদন্তকারী কর্মকর্তা বা জেলখানার জেলারের এই মৃত্যুর খবর নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো।
৬. পুলিশ হেফাজতে বা জেলে কোন মৃত্যুর ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে অতিদ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা এবং মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউএসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ