পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও অত্যাচারে বেলুচিস্তানে পাকিস্তান সরকার কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, মানুষকে আশ্রয়হারা করেছে এবং বহু মানুষকে বসতি থেকে উচ্ছেদ করেছে। আর এসবের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিল স্বাধীনতাকামী বেলুচরা। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে রোল মডেল মানেন। বেলুচিস্তানকে স্বাধীন করার নিমিত্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অস্ত্র তুলেছিলেন এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার(২৭ ডিসেম্বর)পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে একটি সামরিক চেকপোস্টে বিদ্রোহীরা আক্রমণ করে। এবং গুলিতে সাত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
জানা যায়, গত রবিবার বেলুচিস্তানের হারনাই জেলার একটি সিকিউরিটি চেকপোস্টে ডিউটি করছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আচমকা সেখানে হামলা চালায় একদল অজ্ঞাত পরিচয়ের বন্দুকবাজ। এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলে সাতজন সেনাকর্মীর মৃত্যু হয়। জখম হোন আরো বেশ কয়েকজন। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে পাকিস্তানের সেনা তরফ থেকে এই বিবৃতি দিলেও মৃতের সংখ্যা আরো বেশি দাবি করেছেন পুলিশ।
এ পর্যন্ত প্রায় দশবার পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে বেলুচ জাতি। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৪৮ সালেই প্রথমবার বিদ্রোহ শুরু হয়। তারপর ১৯৫৮ থেকে ’৫৯, ’৬২ থেকে ’৬৩ এবং ’৭৩ থেকে ’৭৭ পর্যন্ত বারবার দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচ বিদ্রোহীরা। নির্মম দমননীতি চালিয়ে, বিদ্রোহ দমিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে পাকিস্তান। যতোবারই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়েছে ঠিক ততোবারই পাকিস্তানি সেনারা বেলুচদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। খোদ পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বেলুচিস্তানের মানুষ হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গড়ে প্রায় প্রতিটি বেলুচ পরিবারের একজন করে মানুষ গুম হয়েছে। কেবল গ্রাউন্ডে সেনা পাঠিয়ে নয়, আকাশ থেকেও বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর হামলা করা হচ্ছে।
২০০৩ সালে বেলুচরা আবারও আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই শুরু করে। এতে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ শক্তিবলে বেলুচ বিদ্রোহ সম্পূর্ণ শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। বেলুচ নেতা নবাব আকবর বুগতিকে ২০০৬ সালে একটি পাহাড়ের গুহার মধ্যে অবরুদ্ধ করে নির্মমভাবে খুন করে পাক সেনা। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল আকবর বুগতিকে খুন করতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে বিদ্রোহ। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিদ্রোহের আগুন তারপর দাবানলের মতো ছড়িয়েছে পাকিস্তানিদের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানজুড়ে। স্বাধীনতার দাবি দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে বুগতির হত্যার পর থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির বদলে স্বাধীনতার সংগ্রামে।
বেলুচরা বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা কখনোই অন্যের বশ্যতা মেনে নেয়নি। যে কারণে বেলুচরা কখনোই পাকিস্তানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেলুচরা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর বিভিন্ন সময় বিদ্রোহ করে। স্বাধীনতাকামী বেলুচদের নিকট বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সাহসী সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে। বেলুচ জাতি একই ধরণের বিজয়ের প্রত্যাশা করে এবং শীঘ্রই এই বিজয় অর্জন করবেন বলে এক টুইট বার্তায় জানান বেলুচিস্তানের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। তারা পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তানকে আলাদা করে সেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চান। আর তাদের এই স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলাদেশকে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করেন।
বেলুচিস্তানে এরকম প্রায় আধা ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা আছে, যারা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য লড়ছে। বেলুচিস্তানে আরও যে প্রায় আধা ডজন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল বা গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তারা প্রায়শই তাদের আন্দোলনকে তুলনা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে।
যদিও পাকিস্তানে বেলুচদের স্বাধীনতার লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও অনেক আগে শুরু হয়েছিল। এটা সত্যি, যে ধরণের বঞ্চনা-বৈষম্য এবং জাতিগত-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন গতি পেয়েছিল, পাকিস্তানের বেলুচদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পেছনেও সেরকম অনেক কারণ নিহিত বলে মত দেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের বেলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে মানুষের এই সমর্থনকে সংগঠিত করে এটিকে গণআন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতে পেরেছে, বেলুচিস্তানের বেলায় সেটা অনুপস্থিত। এর কারণ বিশ্লেষণ করে মূলত বেলুচিস্তানের সামন্ততান্ত্রিক ট্রাইবাল সমাজ ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ