উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, হামলা, মামলা, আটক, গুলি ও ভয়কে পাশ কাটিয়ে বিএনপি ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশটি হয়েছে সুষ্ঠুভাবে। মূলত সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি ও সরকারের মধ্যে মতভেদের সূত্রপাত। সমাবেশ নয়াপল্টনে করতে চেয়েছিল বিএনপি শুরু থেকেই। নিরাপত্তার কথা বলে সরকার নয়াপল্টনে করতে দিতে রাজি হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ। এ নিয়েই কথা ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের শুরু। বিএনপি কার্যালয়ের সমানে পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু ও কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের পরও বিএনপি কর্মীরা কোনো সহিংসতার পথ না ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে গোলাপবাগে।
সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং সমাবেশস্থল নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে ব্যাপক মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। সমাবেশের স্থান হিসেবে গোলাপবাগ মাঠের নাম ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই নেতা-কর্মীতে ভরে গেছে। রাতভর তাঁরা মাঠে অবস্থান করে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়েছেন। খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছেন। ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগে সমাবেশের আগে ধরপাকড়, তল্লাশিচৌকি, ধর্মঘট দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে সরকার। কিন্তু এই ভয়ভীতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমাবেশে আসা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যত পথ সরকার বন্ধ করছে, তত পথ মানুষ সৃষ্টি করেছে সামাবেশে আসার জন্য।
সমাবেশগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাইরেও অনেক সাধারণ মানুষ জাতীয় পতাকা নিয়ে যোগ দিয়েছেন। তারা সংখ্যায় অনেক। বেশ কিছু কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপির সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে, ভোটাধিকার হরণ করা। আমাদের দেশে ভোট উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। আমরা পথে-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে দিনমান রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। পাঁচ বছরে একবার এসব আলোচনার পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগ পান নাগরিকেরা। দেশে এখন যেহেতু নির্বাচনব্যবস্থা বলে কিছু নেই, তাই জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে এসব সমাবেশে যোগ দিয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি, লাগামহীন অর্থ পাচার, ঋণ জালিয়াতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে।
ঢাকার সমাবেশে ব্যতিক্রম যা ঘটেছে তা হচ্ছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন না, উপস্থিত ছিলেন না কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অনেক নেতা। তাদের কারাগারে রেখেই দলকে সমাবেশ করতে হয়েছে। ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পুলিশ বাহিনীর আচরণ, হামলা, মামলা, নিপীড়ন আগের সব সমাবেশের সময়কার মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে, সেটা বলাই বাহুল্য।
সমাবেশের দিন ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় এবং ঢাকার প্রবেশপথে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা যেভাবে পেরেছেন, সাধারণ লোকজনকে হেনস্তা করেছেন। সাধারণ পথচারী এবং বাসযাত্রীদের ব্যক্তিগত মুঠোফোন ‘পরীক্ষা’ করার কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। এটি নাগরিকের ন্যূনতম অধিকারের পরিপন্থী। ছাত্রলীগের কর্মীদের এই দায়িত্ব তাদের দলীয়ভাবে দেওয়া হয়েছিল নাকি সরকারিভাবে, সেই প্রশ্ন তোলা নিরর্থক—প্রায় এক দশক ধরে, বিশেষত ২০১৮ সাল থেকে রাষ্ট্র, সরকার, দল একাকার হয়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে এগুলোকে আলাদা করে চেনা যায় না।
বিএনপি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক দিন চার ঘণ্টা সমাবেশ করলে ঢাকার ‘জনজীবন বিপর্যস্ত হবে’ বলে সেখানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ তিন দিন আগেই ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টন এলাকাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে একজন কর্মীর প্রাণনাশের পর ওই এলাকার জনজীবন যে স্বাভাবিক ছিল না, সেটা সবার জানা, এমনকি তারপরও সেখানে পুলিশ আর আওয়ামী লীগের কর্মীদের যুদ্ধংদেহী উপস্থিতি কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিকতার প্রমাণ দেয় না। শুধু তা-ই নয়, সমাবেশের আগের দিন থেকে ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল, সমাবেশের দিন ঢাকায় যান চলাচলের অবস্থা দেখে একে ‘সরকারি হরতাল’ বলেই মনে হয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের যে কত দূর ক্ষতি হয়েছে, সেটা ভুক্তভোগী এবং বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ জানেন।
এর আগে ১২ অক্টোবর থেকে বিএনপি দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নয়টি সমাবেশ করেছে। সেখানকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায় যে জনজীবন যতটা বিপর্যস্ত হয়েছে, তার কারণ, ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট পরিবহন ধর্মঘট। আতঙ্ক যতটা ছড়িয়েছে, তার উৎস ছিল সমাবেশে যারা আসতে চেয়েছেন, তাদের ওপর আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলা, ভীতি যতটা বিস্তার লাভ করেছে, তা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি কর্মীদের আটক এবং তাদের বাড়িঘরে পুলিশের তল্লাশি চালানোর কারণে। কিন্তু এগুলো যে কাজে দেয়নি, তার প্রমাণ হচ্ছে প্রতিটি সমাবেশেই জনসমাগম বেড়েছে। স্বল্পতম সময়ে আয়োজিত ঢাকার সম্মেলনে উপস্থিতি তার একটি উদাহরণ।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বিএনপির ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের শেষ সমাবেশ থেকে কেবল দাবিদাওয়া উত্থাপিত হয়নি, একই সঙ্গে এসব দাবির ভিত্তিতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে বিএনপি সফল হবে কি না, সেটা দেখার জন্য আগামী দিনগুলোর অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং এসব সমাবেশে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ইতিমধ্যে এর কিছু বৈশিষ্ট্য এবং নেতৃত্বের কিছু দিক লক্ষ করা গেছে, যা আলোচনার দাবি করে।
বিভাগীয় এসব সমাবেশের সূচনা থেকেই বিএনপি কর্মীরা কেবল যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন তা-ই নয়, এসব সমাবেশে আসার সময় বিভিন্ন ধরনের হামলারও মুখোমুখি হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কাও করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক লোকের উপস্থিতির কারণে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে বলা হয়েছে। যদিও আগের কোনো সমাবেশেই বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি, তথাপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৪ ডিসেম্বরেও বলেছেন, ‘বিএনপি সমাবেশের নামে যদি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমুচিত জবাব দেবে।’
তবে ঢাকার সমাবেশের আগে বিএনপির কোনো কোনো নেতার বক্তব্য দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হয়নি। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন বা ১০ তারিখের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে—এ ধরনের বক্তব্য আইনের বিবেচনায়ই শুধু নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায়ও যথাযথ বার্তা দেয় না। এতে করে যে ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তা বিএনপির জন্যই ক্ষতিকর।
এসব সমাবেশে কারা যোগ দিয়েছেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে সমাবেশের আগের দিন, এমনকি দুই দিন আগেই অনেকে সমাবেশের জন্য নির্ধারিত শহরে উপস্থিত হয়েছেন। এসব অংশগ্রহণকারী দলের নিবেদিত কর্মী-সমর্থক। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এসব সমাবেশে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। প্রধানত দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের উপস্থিতিই এসব সমাবেশকে বৃহদাকৃতি দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটে দিশাহারা মানুষ এটা বুঝতে পারছেন যে রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান খুঁজতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষেরা তাদের বিবেচনায়ই এখন বিএনপির দিকে তাকিয়েছেন। এটা বিএনপির নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন কি না, সেটাই নির্ধারণ করবে বিএনপি ভবিষ্যতে তাদের দাবিদাওয়ার কোন দিকগুলোকে প্রাধান্য দেন।
সাধারণ মানুষের বড় এক অংশ অর্থনৈতিকভাবে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে। তারা কোনো ধরনের সংঘাত বা সহিংসতার চাপ নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তবে তঁারা এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে তাদের এ অবস্থার পেছনে আছে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং নাগরিক হিসেবে তাদের ন্যূনতম অধিকার না থাকা। ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার, সমাবেশের অধিকার না থাকা এবং জবাবদিহির অনুপস্থিতি এ অবস্থা তৈরি করেছে। শক্তি প্রয়োগ করে যে শাসন অব্যাহত আছে, দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ভয়ের কারণে তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু মানুষ সেই ভীতি থেকে বেরিয়ে আসছে। এটা ক্ষমতাসীনেরা বুঝতে পারছেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
এসডব্লিউএসএস/১৪২২
আপনার মতামত জানানঃ