বাংলাদেশে ২০১৪ সালের পাঁচই জানুয়ারির একতরফা সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই রাজপথে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল বিএনপি। এরপরে বড় কোন আন্দোলন করতে দেখা যায়নি দলটিকে। কিন্তু গত কয়েকমাসে বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় নয়টি সমাবেশ সফল করেছে বিএনপি। গণপরিবহন ধর্মঘট, নানারকম বাধার পরেও সেসব সমাবেশে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী অংশ নিয়েছে।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমাদের বিভাগীয় সমাবেশগুলোর সর্বশেষ সমাবেশ ঢাকায়। এর আগের সমাবেশে তো কোন কর্মসূচী দেই নেই। ঢাকার সমাবেশ থেকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচী দেবো। একটা রাজনৈতিক দল হিসাবে, দশ তারিখের পর কি করা হবে, দাবিদাওয়া তো বলতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, দীর্ঘদিন পরে বিএনপি পুনরায় যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, ঢাকার মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে সেটারই একটা ‘শো-ডাউন’ করতে চায়। রাজনৈতিকভাবে তাদের যে অনেক সমর্থন আছে, এই সমাবেশের মধ্য দিয়েই তারা দেশের মানুষ ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে তুলে ধরতে চায়।
অনেকদিন রাজপথে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না। প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে যেভাবে তারা কর্মী-সমর্থকদের সাড়া পেয়েছে, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা অংশ নিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে ঢাকায়ও যেহেতু এমনিতেই অনেক বেশি মানুষ, অনেক বড় সমাবেশ হবে। এটা তাদের কাছে একটা ‘শো-ডাউনের’ মতো বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ঢাকার সমাবেশ নিয়ে বিএনপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এই জন্য যে, তারা চেষ্টা করছে অনেকদিন পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে এবং তাদের জনসম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে। দলকে চাঙ্গা করার জন্য এটা তাদের খুব দরকার। তারা দেখাতে চায়, তাদের পেছনে মানুষ আছে।
সেই সঙ্গে দেশে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও তাদের দলের সমর্থন তুলে ধরতে চাইছে দলটি। তবে বিএনপির নেতারা মনে করেন, তারা অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতোই একটি সমাবেশ করতে চান। কিন্তু সরকারই পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে।
তিনি বলছেন, একটা রাজনৈতিক দল তাদের সাংগঠনিক বিকাশ ঘটাবে, জনগণের সামনে তার শক্তি দৃশ্যমান করবে, জনগণের পক্ষে কথা বলবে, এটা তো স্বাভাবিক একটা গণতান্ত্রিক ধারার মধ্যে পড়ে, সাংগঠনিক অধিকারের মতো। আমার দল যদি বড় হয়, তাদের অন্যের এতো আশঙ্কা কেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদও বলছেন, যেহেতু একবছর পরে নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচনে তাদের দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, সেই দাবির পক্ষে যে অনেক মানুষ আছে, সেটা দেখানো তাদের জন্য জরুরি। ফলে সমাবেশে তারা যত বেশি মানুষ জড়ো করতে পারবে, বড় সমাবেশ করতে পারবে, তারা মনে করে, তারা দেখাতে পারবে যে তাদের কত সমর্থন আছে।
মেঠো রাজনীতিতে শো-ডাউনের একটা প্রতিযোগিতা থাকে। বিএনপির সমাবেশের পরে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগও নানারকম জনসভা করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেখানে বক্তব্য দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের জন্য ভোট চেয়েছেন। এখানে একটা পাল্টাপাল্টি শো-ডাউনের প্রতিযোগিতা চলছে। এখানে একটা আছে রাজনীতির লড়াই, আরেকটা আছে দলীয় আছে ইগোর লড়াই।
যে ভয় পাচ্ছে আওয়ামী লীগ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দশই ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে রাজনৈতিক অনেক হিসাবনিকাশ রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মঞ্চ তৈরি করে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি।
আবার ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়ার পর তারাও অবস্থান নিয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে হয়।
আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা আশঙ্কা করছেন, বিএনপিকে যদি মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে হয়তো সেরকম কোন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণ আছে। বিএনপি নিজেই এই সমাবেশ নিয়ে তাদের আলাদা কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে আগে জানিয়েছে, যাতে হয়তো পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনরকম চিন্তিত নয়, কোন গুরুত্বও দিচ্ছে না।
‘আমার মনে হয় না আওয়ামী লীগ এটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মিডিয়া বিভিন্ন সময় প্রচারের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গিয়ে জানতে চায়, বিএনপি নেতারা এই বললো, আপনাদের বক্তব্য কি? অনেক সময় আমাদের নেতারা হয়তো বিভিন্ন বক্তব্য দেয়, তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ চিন্তিত। বিএনপির সমাবেশ বিএনপি করবে, তাতে আওয়ামী লীগের কি আসে যায়?’
‘বিএনপির সমাবেশ নিয়ে, সমাবেশের অনুমতি, স্থান নির্ধারণ-এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এখানে আওয়ামী লীগের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুব বেশি কিছু ভাবছে বলে আমি মনে করি না।’
তবে ঢাকায় ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন নেতা নানারকম বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সমাবেশের স্থান নিয়েও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলেও দলটি চাইছে নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে।
এর আগে যে নয়টি বিভাগীয় শহরে বিএনপির সমাবেশ হয়েছে, সেখানে সরাসরি কোন বাধা দেয়া না হলেও, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার এবং সরকারি দল নানানভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, যাতে বিএনপির সমাবেশে বেশি লোকজন না আসতে পারে।
বাধা সৃষ্টি আওয়ামী লীগের
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনে বলেছেন, ‘১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা (বিএনপি) জানান দিল যে, তারা সন্ত্রাস করবে। আবার আগুন সন্ত্রাস ফিরে আসছে। খেলা হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারা দেবে নেতা-কর্মীরা।’
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোর মতো ঢাকা সমাবেশেও পরোক্ষভাবে বাধা তৈরি করা হবে আওয়াম লীগের পক্ষ থেকে। এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকার অনেক হোটেল ওই সময় খালি রাখার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।
র্যাব জানিয়েছে, ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) কিছুটা আতঙ্কিতও। আওয়ামী লীগ এবং তাদের নানান অঙ্গ সংগঠন যেভাবে বলছে, পাহারা দেবে, যে সমস্ত কথা বলছে, তাতে বোঝা যায় যে, তারা চিন্তিত। যদি কোন কারণে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বিএনপির দাবি যদি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাহলে তো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করে, তাদের জন্য ভালো হবে না। ফলে তাদের মধ্যে চিন্তা আছে। আবার বিএনপিও চাইবে, যত বেশি চাপ দিয়ে এটা আদায় করার চেষ্টা করবে।’
এসডব্লিউএসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ