বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু গত পাঁচ বছরেই দেশের ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ অন্তত ৭০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮ সালের জুন শেষেও ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৯৯ হাজার ৮১ কোটি টাকা।
অর্থনীতি বড় হলে অর্থের পরিমাণ ও চাহিদা বাড়বে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে যে হারে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ছে সেটি অস্বাভাবিক। ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ চলে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপাতে বাধ্য হচ্ছে।
নগদভিত্তিক অর্থনীতির আকার বড় হওয়ায় অবৈধ হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গত এক দশকে দেশে ব্যাংক খাতের বিপুল সম্প্রসারণ হয়েছে। ব্যাংকিং সেবা অনেক বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংক সেবা পৌঁছে গেছে। তার পরও দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
এর জন্য ব্যাংকের কেলেঙ্কারিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি হাইকোর্টও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছে যা মোটামুটি সচেতন মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগের দিকে ইঙ্গিত করে হাইকোর্ট বলেছেন, সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমরা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো? এটা কি হয়? আদালত বলেন, এসব অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন যা করছে তাতে মনে হয়, আমরা নাটক দেখছি। হাততালি দেয়া ছাড়া আর কী করার আছে, না হয় বসে থাকতে হবে। গতকাল বেসিক ব্যাংকের অর্থপাচারের মামলার আসামি মোহাম্মদ আলীর জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
ব্যাংকেএ উপর মানুষের অনাস্থা নগদের এক বিপরীত প্রবাহের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত ইস্যুকৃত মুদ্রার পরিসংখ্যান তৈরি করে। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির একটি দেশে কী পরিমাণ নগদ অর্থের প্রয়োজন সেটিও পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু কোনো পরিসংখ্যানেই ইস্যুকৃত অর্থের অন্তত ২৫ শতাংশের অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছে না। এটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উদ্বেগ রয়েছে।
অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে মুদ্রা ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। বাংলাদেশে সরকারি মুদ্রা হলো ১, ২ ও ৫ টাকার নোট এবং কয়েন। সরকারের ইস্যুকৃত এ ধরনের মুদ্রা রয়েছে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ও গভর্নরের স্বাক্ষরযুক্ত নোট ব্যাংক নোট হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক নোট হলো ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকার কাগুজে মুদ্রা। বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৫৬-৭০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১০-১২ শতাংশ নগদ হিসেবে বাজারে থাকাই যথোপযুক্ত। কিন্তু গত এক দশকে বাজারে নগদ অর্থের পরিমাণ ও হার বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ১৭ শতাংশ বাজারে নগদ অর্থ হিসেবে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে প্রতি বছরই ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে এসে এ অর্থের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে ওই বছরও ব্যাংক খাতের মোট আমানতের সাড়ে ১৩ শতাংশ নগদে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। নগদ এ অর্থের মধ্যে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকাই ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ