২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, পরকীয়া আর অপরাধ নয়৷ এই রায়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে৷ অনেকে বলেছেন, নারীর অধিকারকে পূর্ণতা দিয়েছে এই রায়৷ কারো মতে, এই স্বাধীনতা আদতে সমাজজীবনে নৈরাজ্য ডেকে আনবে। তবে পরকীয়া সামাজিক ব্যাধি, অপরাধ নাকি প্রয়োজন, এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে আছে আমাদের সমাজে।
ইতিহাস ও সমাজে পরকীয়া
সমাজে পরকীয়া সম্পর্ক অবিশ্বাস্যহারে বাড়ছে। প্রায় সব দেশেই পরকীয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৬ সালে সোশাল সার্ভেতে জানা যাচ্ছে, বিবাহিতদের মধ্যে স্ত্রীকে লুকিয়ে অন্য মহিলার সাথে সেক্স করেছেন এমন পুরুষের সংখ্যা নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ। ব্রিটেনে ২০০০ সালের এক গবেষণা বলছে, একই সাথে একাধিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন ১৫% পুরুষের। অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৯%। ফ্রান্সের ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক ওপিনিয়নের জনমত জরিপ বলছে, প্রায় অর্ধেক (৫৫%) ফরাসী এবং ইতালিয়ান পুরুষ স্বীকার করেছেন যে জীবনের কোন এক সময় তারা জীবনসঙ্গীকে ঠকিয়ে অন্যের সাথে সম্পর্কে করেছেন।
ঐ একই জরিপে ৩৪% ইতালিয়ান মহিলা এবং ৩২% ফরাসি মহিলা একইভাবে পরকীয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মানুষের যৌন আচরণ সম্পর্কে জানতে কনডম প্রস্তুতকারী কোম্পানি ডিউরেক্স ২০০৫ সালে একটি বিশাল জনমত জরিপ চালায়। এই জরিপে ৪১টি দেশে মোট ৩১৭০০০ মানুষের মতামত নেয়া হয়। এই জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, পরকীয়ার কথা স্বীকার করে এমন পুরুষের সংখ্যা তুরস্কে বেশি।
ইতিহাসে ফিরলেও আমরা পরকীয়া দেখতে পাই। প্রাগৈতিহাসিক যুগ বা প্রাক আর্যযুগে এবং পরবর্তী বৈদিকযুগের প্রথমদিকেও সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ যৌন সম্পর্ক চালু ছিল। নারীর কৌমার্য বা সতীত্ব বলতে যা বোঝায়, তখন তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল না। ভারতবর্ষে বিবাহ প্রথা চালু করেন মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু। তার আগে পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সংজ্ঞা বলতে বোঝাতো মূলত যৌনসঙ্গী। মহাভারত যুগে বিবাহ প্রথার মাধ্যমে নির্দিষ্ট যৌনসঙ্গী নির্বাচন ব্যবস্থা চালু থাকলেও সমাজে তখনও কিছু অবৈধ যৌন সংসর্গের ঘটনা ঘটতে থাকে। তাই মহাকাব্যের যুগে মহাভারতে কুমারী কন্যার গর্ভজাত সন্তানকে “জারজ” না বলে তাকে “কানীন” বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
পরকীয়া বিস্তারের ইতিহাস ঘাঁটলে আপনি দেখবেন, কয়েক যুগ আগেও বহুপত্নিক পরিবার ব্যবস্থা ছিল, এখনো আছে কম মাত্রায়। সময়ের বিবর্তনে বহুপত্নিক পরিবারের পরিবর্তে ‘এক নারী এক পুরুষের’ যৌননিষ্ঠার ধারণার ভিত্তিতে একগামী পরিবার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে, একক বিয়ে প্রথা চালু হয়েছে।
আমাদের সমাজে এমন কি ধর্মেও এই পরকীয়া সম্পর্ককে অবৈধ সম্পর্ক হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু কখনও কি আমরা এটা জানার বা বোঝার চেষ্টা করেছি, কেনো আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে এই সম্পর্কের হার বেড়ে গিয়েছে? নারী বা পুরুষ তাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে কি সন্তুষ্ট নন? চলুন জেনে নেওয়া যাক, মানুষ কেন পরকীয়া সম্পর্কে জডায়।
পরকীয়া সম্পর্কের কারণ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। প্রথমে আসে দৈহিক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। সেক্স মানুষের একটি শরীরবৃত্তীয় চাহিদা। যদি স্বামী-স্ত্রীর যৌনজীবন দুর্বল হয়, তাহলে অপর ব্যক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে।
কারো মধ্যে যদি ডিআরডিফোর জিনের উপস্থিতি বেশি হয়, তাদেরও পরকীয়া বা বাড়তি সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকতে পারে।
অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় মানসিক সমস্যার কারণেও মানুষ পরকীয়ায় জড়াতে পারে। যাঁদের মধ্যে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আছে, তাদের পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তারা কোনো কিছুর মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পায় না। সঙ্গীর উদাসীনতা ও দূরত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী বাস্তবতার কারণে, কাজের কারণে হয়তো দূরে চলে যায়। তখন তাদের মধ্যে পরকীয়ার আগ্রহ বাড়।
নিম্নে পরকীয়ায় জড়ানোর প্রধান কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলো।
ভুল সঙ্গীকে নির্বাচন
মূলত এই সমস্যাটি বেশি দেখা যায় অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বা অভিভাবকের পছন্দানুযায়ী বিয়ে করার ক্ষেত্রে। অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের নিজেদের কথাই ভাবেন এবং ভাল-মন্দ কোনো কিছু না দেখে-শুনে অনেক তাড়াহুড়ো করেই তাদের সন্তান দের বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের পছন্দ বা মতামতকে তারা প্রাধান্য দেন না। যার ফলে এসব ছেলে-মেয়েদের বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। আর তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পরবর্তীতে তারা পরকীয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
অল্প বয়সে বিয়ে
আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক তরুণ তরুণী কম বয়সে বিয়ে করে ফেলে। এই সময়ে ছেলে বা মেয়ের মধ্যে মানসিক বুদ্ধি-চিন্তা কাজ করে না। যুক্তির চেয়ে আবেগই বড় হয়ে দেখা দেয়। যার কারণে বিয়ের কিছুদিন পরই সেইসব স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন রকমের মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং এই সময়েই সেই স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, একসময় এই বিবাহিত জীবন ডিভোর্স এর পর্যায় চলে যায়।
শারীরিক সমস্যা
বিবাহিত জীবনে এটি হচ্ছে প্রধান সমস্যা। এই সমস্যাটি তখনই দেখা দেয়, যখন স্বামী ও স্ত্রী সমবয়সী হয় অথবা স্বামীর থেকে স্ত্রী যদি বয়সে বড় হয়ে থাকে। যার কারণে সেসব স্বামী বা স্ত্রী বাইরের অন্য কারো সাথে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
বিয়ের অল্পকিছু দিন পরই অভিভাবক হওয়া
কথাটি বেশ কড়া হলেও এটাই বাস্তব যে, বিয়ের পর স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যের মধুর সম্পর্কে তখনি ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যখন তারা অভিভাবক হয়ে যান। একটা সন্তান পরিবারে আসার পর মূলত সন্তানদের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সন্তানদের নিয়ে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রী কেউই একে অপরকে সময় দিতে পারছে না। যার কারণে আগের মত সেই মায়া, ভালবাসা থাকে না। তখনই সেসব পুরুষ বা নারীদের মন বাইরে চলে যায় অর্থাৎ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
ক্যারিয়ার আডভান্সমেন্ট
খুব দুঃখজনক হলেও, এটাই সত্যি। কিছু পুরুষ বা নারী তার ক্যারিয়ার প্রমোশন দ্রুত বৃদ্ধি করার জন্য তার কর্মস্থল এর ম্যানেজার কিংবা উপরের লেভেলের বসদের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত হন। কারণ তারা মনে করেন এতে করে তারা জব এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই ভুল চিন্তা! উল্টো এটা একটা মানুষের ব্যক্তিস্বত্তা, তার চরিত্র স্বত্তাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। এসব সম্পর্কও যেমন বেশিদিন টিকে না, ঠিক তেমনিভাবে চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে ১০০%। পরবর্তীতে এগুলোর প্রভাব পড়ে পরিবারের সন্তানদের উপর। বিশ্বাস, ভালবাসা, সম্মান সবকিছুই বিনষ্ট হয়ে যায়, এই সাময়িক পরকীয়া সম্পর্কের কারণে।
মোবাইল ফোনের অপব্যবহার
মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের মাধ্যমেও পরিবারে পরকীয়ার সম্পর্ক দ্রুতহারে বাড়ছে। পরকীয়া মহামারীর অন্যতম কারণ বর্তমানে মোবাইল ফোনকে দায়ী করছেন সমাজবিদরা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নতুন নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগ ও পরিচয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠছে নানা সম্পর্ক। দেখা যাচ্ছে, এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিদেশি ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশে চলে আসছে, শেষ পর্যন্ত পরিণয়ে পরিণত হচ্ছে।
প্রবাসী জীবন
দীর্ঘদিন স্বামী প্রবাসে থাকার সুযোগে স্ত্রীরা পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এই বিষয়টি সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করছে। দেখা গেছে বর্তমানে যত নারী বা পুরুষ ঘটিত কেলেঙ্কারি দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশ স্বামী প্রবাসী। এমনও দেখা গেছে, স্বামীর সব সম্পদ কৌশলে ভাগিয়ে নিয়ে পরকীয়া ছেলের সাথে চলে যাচ্ছে। নিজের সন্তান পর্যন্ত হত্যা করতে দ্বিধা করছে না পরকীয়া নারী বা পুরুষ।
এসডব্লিউএসএস/১৫৩৬
আপনার মতামত জানানঃ