বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে উন্নত অনেক দেশের মতো বিয়ে বা সামাজিকভাবে স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের একত্রে বসবাস বা লিভ টুগেদার করতে দেখা যাচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে লিভ টুগেদার সামাজিকভাবে স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজে ছেলে-মেয়ের বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক বা একত্রে থাকা এখনও বাঁকা চোখে দেখা হয়।
যার ফলে বাংলাদেশে এখনও এ ধরনের সম্পর্ক খুবই সীমিত পরিসরে এবং গোপনে রয়েছে। তবে বিশ্বায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের সম্পর্কের সংখ্যা ধীরে হলেও বাড়ছে বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন।
যে কারণে লিভ টুগেদারে আগ্রহ বেড়েছে
লিভ টুগেদারে বাংলাদেশের যুগলরা কতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছে, এ নিয়ে বাংলাদেশে এখনো কোন গবেষণা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রেম থেকে, একাকীত্ব কাটানো বা আর্থিক সাশ্রয়ের কথা ভেবে অনেকে এভাবে সম্পর্কে জড়ান বলে ধারণা করা হয়।
এমন অনেক দম্পতি রয়েছে, যারা একসময় লিভ টুগেদার করতেন, তবে এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ রয়েছেন, যারা একসময় লিভ টুগেদারে থাকলেও সেই সম্পর্ক এখন ভেঙ্গে গেছে। তবে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান ঢাকায় বসবাসকারী এক যুগল।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিচালক নীনা গোস্বামী বলছেন, ”আমাদের কাছে এমন অনেক অভিযোগ আসে, যে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে একত্রে বসবাস করেছেন। কিন্তু এখন বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। তারা সরাসরি লিভ টুগেদার করার কথা বলে না। কিন্তু এ ধরণের অভিযোগের সংখ্যা একেবারে কম নয়।”
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতারণা বা বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। তবে বাংলাদেশের ধর্মীয় বা সামজিকভাবে গ্রহণযোগ্য না হলেও অনেকে বিয়ে ছাড়াই একত্রে থাকার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন
খোঁজ নিয়ে যানা যাচ্ছে, শুধু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নয়, সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যেও এভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া একত্রে বসবাসের চল রয়েছে।
একটি কারখানার কর্মকর্তা সিদরাতুল মুনতাহা বলছেন, ”পেশাগত কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, নিজেদের মধ্যে ভালোলাগা থেকে অনেক কর্মী বা শ্রমিক আনুষ্ঠানিক কোন সম্পর্ক ছাড়াই একত্রে বসবাস করছেন। সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হলে অনেক সময় আমাদের কাছে অভিযোগও আসে। আবার কিছুদিন পরে হয়তো তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, আবার নতুন কারও সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। ”
যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে লিভ টুগেদার করতে গিয়ে নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে যুগলদের।
যেমন বাসা ভাড়া নেয়া বা বাসার কাজের লোকজনের কাছে বিবাহিত হিসাবে পরিচয় দিতে হচ্ছে এই যুগলকে।
এমন এক যুগল জানায়, ”আমরা বিবাহিত, এটা বলে আমাদের বাসা নিতে হয়েছিল এবং সবসময়ই সতর্ক থাকতে হয়েছিল বাড়ির মালিকের সামনে। তবে সুখের বিষয়, তিনি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশি কৌতূহলী ছিলেন না।”
জানা যায়, ঢাকার একটি বাসায় তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন। কিন্তু তারা যে বিয়ে না করে একত্রে বাস করছেন, সেটা হাতেগোনা কয়েকজন খুব কাছের বন্ধু জানেন। এমনকি দুই পরিবারের লোকজনও এই বিষয়ে জানে না। তারা বলেন, ”যারা আমাদের জাজ করবে না বা বিষয়টি নেতিবাচকভাবে দেখে না, শুধু তারাই আমাদের এই বিষয়টি জানে।”
তারা বলেন, ”এটা সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরস্পরের মানসিকতার সামঞ্জস্য না হলে একসাথে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়। আমাদের বেলায় কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে দুই পক্ষকেই। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আমার যতটুকু করার ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি সঙ্গীর থেকে। এটা সম্ভব হয়েছে তার সাথে মানসিকতার মিল থেকেই।”
সমস্যা নিয়ে তারা বলেন, বাড়িওয়ালা বা বুয়া বা আশেপাশের লোকজন অনেক সময় ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করে শ্বশুর বাড়ি কেমন, কীভাবে বিয়ে হল। তখন আমাকে সবসময়ে একটা গল্প তৈরি করে রাখতে হয়। মনে রাখতে হয়, আমি আগেরবার কী বলেছি, সেটার সঙ্গে যেন মিল থাকে। খুবই সাবধানে থাকতে হয় বিষয়টা নিয়ে। এমনকি একজন সঙ্গীর বাড়ির লোকজন এলে তখন অন্যজন বন্ধু বা অন্য কোথাও কয়েকদিন থেকে আসেন।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কি পাল্টাচ্ছে?
এখনও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বিয়ে অথবা সামাজিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ছেলে-মেয়ের একত্রে বসবাসকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা নাসরীন বলছেন, ”সমাজ তো পরিবর্তন হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলেও বিশ্বায়নের কারণে মানুষের আচরণে একটা পরিবর্তন তো হচ্ছেই। উন্নত দেশ, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশেও ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে একসাথে বসবাসের চল তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হওয়ায় এটা লুকানো রয়েছে। তবে এই অনুশীলন কিন্তু দেখা যায়।”
তিনি বলেন, ”বিশ্বায়নের কারণে অনেক কিছুর অনুকরণ হতে দেখি। সেটার একটা প্রভাব তো সমাজের ওপর পড়ে। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া সব জায়গাতেই লাগে। সমানভাবে না লাগলেও কোথাও কোথাও সেটা স্পর্শ করে যায়। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
অধ্যাপক নাসরীন বলছেন, ”আমি বলবো, প্রতিবেশী দেশ বা অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে হয়তো সংখ্যাটা এখনো নগণ্য। তবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কোন কোন জায়গায় হচ্ছে, সেটা তো পরিষ্কার। তবে মানুষের মধ্যে এই ধরনের জীবনযাপন বাংলাদেশে ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়।”
বাংলাদেশের আইন কী বলে?
বাংলাদেশের আইনে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের লিভ টুগেদার করার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন পরিষ্কার আইন নেই বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার মিতি সানজানা।
তিনি বলেন, ”বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোন নারী-পুরুষ যদি একসঙ্গে বসবাস করতে যায়, তাহলে তাকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বিবাহিত হতে হয়। যেমন মুসলিম আইন অনুযায়ী তাকে রেজিস্ট্রেশনও করতে হবে। কিন্তু কেউ রেজিস্ট্রেশন না করেও ধর্মীয় বিধান মেনে সাক্ষীর উপস্থিতিতে যদি বিয়ে করে, সেটাও গ্রহণ করা হয়।”
ব্যারিস্টার সানজানা বলছেন, বিবাহিত ব্যক্তি যদি কোন বিবাহিত বা অবিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে লিভ টুগেদার করে, সেটা নানারকম আইনের মধ্যে পড়ে, নানা শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি একত্রে বসবাস করে, সেক্ষেত্রে আইনে সরাসরি বা পরিষ্কারভাবে কিছু বলা নেই।
তিনি আরও বলেন, ”তবে প্রত্যেকটা ঘটনার ক্ষেত্রে আসলে ফ্যাক্টচুয়ালি ডিপেন্ড করবে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো পাবলিক ইনডিসেন্সি মনে করা হতে পারে। তবে সরাসরি কোন আইনের ধারায় সরাসরি কিছু করার সুযোগ নেই। সাধারণত যা হয়, এরকম ক্ষেত্রে আইনি বিষয় চলে এলে তখন নানারকম আইনের আওতায় কোন একটাভাবে তাদের ফেলে দেয়া হয়।”
উন্নত দেশগুলোয় একত্রে বসবাস করলে সঙ্গীর একটা অধিকার তৈরি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কোন বিধান নেই বলেও তিনি জানান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ