পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যখন বুদ্ধিমান প্রাণীতে বিবর্তিত হয়েছে, তাহলে অন্য কোনো প্রাণী তা করতে পারেনি কেন? অন্য প্রাণীদের কি এইভাবে বিবর্তিত হওয়ার সুযোগ ছিল না?
আসলে প্রাণীদের সঙ্গে মানবজাতির বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক করা কঠিন বলে মনে হয়। তবে গবেষকরা মনে করেন এটি একটি ভুল ধারণা। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে মানুষের মস্তিষ্ক এবং প্রাণীর মস্তিষ্কের সাথে খুব একটা মিল নেই। আর এই কারণে বুদ্ধিমত্তার দিকদিয়েও মানুষের চেয়ে পিছিয়ে তারা।
তবে অনেক বিষয় বিবেচনা করে বলা যায়, প্রাণীরা খুব বুদ্ধিমান। এটি তাদের কার্যকলাপ দ্বারা সহজেই প্রমাণ করা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাণীরা মানুষের চেয়ে বেশি মেধার পরিচয় দেয়। তাই কখনো ভাবা যাবে না যে আমরা মানুষ হিসেবে সবসময় বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে আছি।
তবে আমাদের সঙ্গে প্রাণীদের বুদ্ধির পার্থক্য এই যে, আমরা চাইলেই মেধাবী প্রাণীদের যে কোনো কার্যক্রমকে পরাস্ত এবং প্রভাবিত করতে পারি। কিন্তু প্রাণীরা সেটি পারবে না। আজ আমরা কিছু বুদ্ধিমান প্রাণী সম্পর্কে জানবো, যারা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে হয়তো মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে ভবিষ্যতে।
হাতি
হাতিদের বুদ্ধি বেশ প্রখর। এরা এদের আত্মীয়-স্বজনের, তাদের মাথার খুলি দেখে শনাক্ত করতে সক্ষম, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না বললেই চলে। এরা খুবই সামাজিক প্রাণী, পরিবারের সবাই একসঙ্গে থাকে। এদের মধ্যে কেউ মারা গেলে এরা মৃতদেহের প্রতি শোক পালন করে, মৃতদেহ পচা শুরু না হওয়া পর্যন্ত এরা মৃতদেহের পাশেই অবস্থান নেয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মধ্যে যা আছে সেটা প্রাণীদের মধ্যেও থাকতে পারে। এবং তারা অনেকটা মানুষের মতোই আচরণ করে থাকে।
“মানুষের মতো হাতিও সামাজিক জীব। আমাদের সমাজে ও ব্যক্তি জীবনে যা কিছু ঘটে, হাতির সমাজে এবং জীবনেও তার প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটে। হাতিও দলবদ্ধ প্রাণী। এখন বিষয়টা হচ্ছে আমরা হাতির কাছ থেকে শিখেছি না হাতি আমাদের কাছ থেকে শিখেছে!”
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ নিশ্চয়ই হাতির কাছ থেকে শিখেছে। কারণ হাতি আমাদের কয়েক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে। হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সংবেদনশীল প্রাণী। অ্যারিস্টটল একবার বলেছিলেন, হাতি হচ্ছে সেই প্রাণী যে বুদ্ধির দীপ্তি ও স্মরণশক্তির দিক থেকে অন্য সকলকে অতিক্রম করেছে।
হাতি স্থল প্রাণীদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড়। তাদের মস্তিষ্কও সবচেয়ে বড়। মানুষের যতো নিউরন আছে তার চেয়েও তিনগুণ বেশি আছে হাতির।।
ভারতে দেখা গেছে হাতি আটকাতে ইলকেট্রিক বেড়া দেওয়ার পর তারা প্রথমে তার ওপরে গাছ ফেলে সেখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে এবং তার পর ওই পথ দিয়ে চলাচল করেছে। ড্রাম পটকা ফোটালে কিছুদিন পর ওরা বুঝে ফেলে যে ওদের ভয় দেখানোর জন্য এসব ফোটানো হচ্ছে। বিশ্বের অনেক চিড়িয়াখানাতে গেলেও সেখানে এখন হাতিদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়। অনেক গ্যালারিতে হাতির ছবি আঁকাও সরাসরি প্রদর্শন করা হয়। তারা নানা ধরনের হাতিয়ারও ব্যবহার করতে পারে। তাদের স্মৃতিশক্তি প্রখর।
তিমি ও ডলফিন
তিমি আর ডলফিনের নাকি এমন সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা মানুষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়, বলে জানিয়েছেন মেরিন বিজ্ঞানীরা৷ অনেক দিন ধরে গবেষণা করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন৷
আত্মসচেতনতা এবং ব্যথা ও দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করে তা কীভাবে কমানো যায়- এসব বিষয়ে মানুষ যেমন বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে কাজ করে থাকে, ঠিক তেমনভাবেই তিমি আর ডলফিনও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ এছাড়া একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিলেমিশে থাকার মানুষের যে স্বভাব, তাও অনেকটা পাওয়া যায় তিমি আর ডলফিনের স্বভাবে৷ অর্থাৎ আগে যেমন ধারণা করা হতো যে, তিমি আর ডলফিন অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধিমান, তারা আসলে তার চেয়েও বেশি বুদ্ধি রাখে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন৷
আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোবায়োলজিস্ট লোরি মারিনো একটা ডলফিনের গায়ে চিহ্ন এঁকে দিয়ে তাকে আয়নার সামনে নিয়ে গেলে ডলফিনটি আয়নায় নিজের চেহারা আর ঐ চিহ্নটি দেখে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে ঐ বিজ্ঞানী নিশ্চিত হন যে ডলফিনরা অনেক বেশি আত্মপরিচয়বোধসম্পন্ন৷
এছাড়া বিজ্ঞানীরা ‘ওরকা’ নামের ডলফিন প্রজাতির একটি প্রাণীর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, যে তারা খুব চতুরভাবে ‘লংলাইন’-এ বিদ্ধ মাছ চুরি করতে পারে৷ উল্লেখ্য, বাণিজ্যিকভাবে যারা মাছ শিকার করেন তারা অনেকেই মাছ মারার জন্য বর্শা জাতীয় এক ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করেন৷ আর এটাই হলো লংলাইন৷
এদিকে মানুষের মস্তিস্কের আকারের পরই অবস্থান তিমি আর ডলফিনের মস্তিস্কের আকার৷ আর তাই তাদের বুদ্ধির পরিমাণও মানুষের কাছাকাছি৷
মাকড়সা
এটি এমন একটি উচ্চ বুদ্ধিমত্তার স্তরের ক্ষুদ্রতম প্রাণী। বিশেষ করে সাদা-গোঁফযুক্ত পোর্টিয়া স্পাইডারদের অন্যকে দেখে বিশেষ কিছু শেখার দক্ষতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রধানত আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় এদের দেখতে পাওয়া যায়। মাকড়সার জাল টানলে অনেক লম্বা হয়, কিন্তু সহজে ছিঁড়ে না। এর প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা স্টিলের চেয়েও বেশি। পা এবং হাঁটার কৌশলের কারণে ওরা নিজেদের জালে নিজেরা আটকে যায় না। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির মাকড়সা আছে। মাকড়সা অনেক পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এরা না খেলে পোকামাকড়গুলোর সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে যেত।
পিঁপড়া
আকারে খুব ছোট হলেও এরা উচ্চ বুদ্ধিমত্তার জন্য পরিচিত। পিঁপড়া পরিবেশের এমন বিপর্যয় সহ্য করতে পারে যা অন্য প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। এছাড়াও তারা সর্বদা বিশাল গোষ্ঠী নিয়ে বসবাস করে। আবার তারা সহজেই তাদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে। পোকামাকড়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তিষ্কের অধিকারী পিঁপড়া। বিশ্বে পিঁপড়ার প্রায় ১২ হাজার প্রজাতি রয়েছে। এই প্রাণীটি তার শরীরের ওজনের চেয়েও ২০ গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারে! পিঁপড়াদেরও একজন রাণী থাকে যার থেকে লক্ষাধিক বাচ্চা হয়। পিঁপড়ার কান নেই। তাই মাটির কম্পন থেকেই শব্দের ব্যাপারটি বুঝে নেয়।
বেবুন
বেবুন হলো অনেক পুরনো বানর যা সবসময় শিম্পাঞ্জি এবং ওরাংগুটানদের জাতের সাথে সম্পর্কিত। যদি কখনও তাদের আচরণ লক্ষ্য করেন, আপনি দেখতে পাবেন যে তারা কীভাবে মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এমনকি গবেষণা থেকে দেখায় যে বেবুনগুলো তাদের নিজস্ব চাপ অনুভব করতে পারে এবং তারা জটিল সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে পারে। প্রাণী সমাজের ন্যায় বাস করায় বেবুনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়।
কাক
ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ বার্ড বলেছেন, ‘কাকের কিছু সহজাত বুদ্ধিমত্তা এবং জটিল চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। কাক সক্রিয়ভাবে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে পারে এবং পরীক্ষায় দেওয়া বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে। একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে সফল না হওয়া পর্যন্ত কাক বারবার চেষ্টা করতে থাকে ও সমস্যার সমাধান বের করে ফেলে।
গবেষণায় দেখা যায়, কাক হলো সবচে বুদ্ধিমান পাখি, যার বুদ্ধি প্রায় ৫-৭ বছর বয়সী শিশুর সমান।
কাকের কিছুটা ভালো যৌক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে স্ব-নির্মিত ম্যাচিং সরঞ্জামের মাধ্যমে খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারে। যা বেশিরভাগ প্রাণীর বুদ্ধিমত্তাকেই হার মানায়।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানবজাতির মতোই কাকেরও নিজেদের চেতনা আছে, অর্থাৎ বিশ্বকে বোঝার জন্য তাদের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/০৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ