ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন লিজ ট্রাস। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ছয় সপ্তাহের মাথায় বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
এদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে এক বিবৃতিতে পদত্যাগের বিষয়টি জানান তিনি।
লিজ ট্রাস বলেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বিষয়টি রাজা তৃতীয় চার্লসকেও অবহিত করেছেন বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করব।’
এর আগে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে সংক্ষিপ্ত বাজেট ঘোষণা করেন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ারতেং। ওই বাজেটে কর ছাড়ের ছড়াছড়ি থাকায় বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। পুঁজিবাজারেও অস্থিরতা শুরু হয়।
এক পর্যায়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড মূল্যমান হারিয়ে কয়েক দশকের সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে যায়। এরপরেই গত শুক্রবার ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে লিজ ট্রাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কাওয়াসি। এর পর দায়িত্ব ছাড়ার কথা জানান।
এই রেশ কাটতে না কাটতেই দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান গতকাল বুধবার পদত্যাগ করেন। এরপরেই আজ লিজ পদত্যাগ করলেন।
ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি আরও বলেন, আমি ব্রিটিশ রাজা চার্লসকে পদত্যাগের বিষয়টি জানিয়েছি।
যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে না পারায় সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভোট দেওয়ার পর রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত ব্রিটেন এর আগে তিন জন প্রধানমন্ত্রীকে হারিয়েছে। আর ট্যাক্স কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত মাসে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে আসেন লিজ ট্রাস। ক্ষমতায় এসেই অজনপ্রিয় বাজেট প্রণয়ন এবং কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। এসব পদক্ষেপ তার দলকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। যার ফলশ্রুতিতে তাকে এখন রাজনৈতিকভাবে টিকে না থাকতে পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন তিনি।
গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে হারিয়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হন লিজ ট্রাস। কিন্তু এক মাসের মাথায় অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেংকে বরখাস্ত করেন তিনি। মূলত এরপরই তার প্রধামন্ত্রিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
গত কয়েকদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী ট্রাসকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা। তারা বলেন, লিজ ট্রাসের সময় ফুরিয়ে এসেছে। তাকে পদত্যাগ করতে হবে। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানের পদত্যাগের পর চাপ আরও বাড়ে।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন টোরি এমপি প্রকাশ্যে লিজ ট্রাসকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। দলের সদস্যদের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে এদিনই ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ট্রাস। এরপরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময় দায়িত্ব পালনকারী প্রধানমন্ত্রীর ত্বকমা পেলেন ট্রাস। মাত্র ৪৫ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ট্রাসের পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী হলেন জর্জ ক্যানিং। ১৮২৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১১৯ দিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে যুক্তরাজ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে।
টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নগদ অর্থ সংকেট থাকা মানুষ খরচ কমিয়ে দেওয়ায় এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তর বুধবার জানিয়েছে, ১২ মাসে আগস্টে থাকা ৯.৯ ভাগ থেকে সেপ্টেম্বরে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১ ভাগে। যার মাধ্যমে জুলাইয়ে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল সেপ্টেম্বরে এটি আবার সমান হয়েছে।
মানুষের সাধারণত তিনবেলা খাবার খাওয়ার কথা থাকলেও জীবনযাত্রার সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের অর্ধেক পরিবার এখন খাবারের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।
ওএনস জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়েছে ১৪.৬ ভাগ। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বড় কারণ।
মুদ্রাস্ফীতি আবারও দুই অংকে পৌঁছার বিষয়টি ইংল্যান্ড ব্যাংকের জন্য চিন্তার কারণ হবে। সুদের হার নির্ধারণে আগামী ৩ নভেম্বর ব্যাংকটি বৈঠকে বসবে। গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি বলেছেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কর ছাড় নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক ইউটার্নের বিপক্ষে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ মূল্যনির্ণয় করবে।
অর্ধহারে লাখ লাখ মানুষ
অর্ধাহারে দিন কাটছে ব্রিটেনে বাসিন্দাদের একাংশের! সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। কস্ট অফ লিভিং বা জীবনধারণের খরচ বেড়েছে অনেকটাই। তাই খরচ কমাতে অনেকেই একবেলা না খেয়ে কাটাচ্ছেন। নয়তো চাহিদা মতো পুষ্টিপূরণ হচ্ছে না তাদের। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ব্রিটেনের কনজিউমার গ্রুপ ‘হুইচ?’ ৩ হাজার জনের উপর একটি সমীক্ষা চালায়। তাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গৃহীত নমুনার ৮০ মানুষ মনে করছে মূল্যবৃদ্ধির জেরে স্বাস্থ্যকর থাবার জোগার কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে অনেককেই একবেলা খাবার জোগার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জানা গেছে, ব্রিটেনে খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। যার জেরে নয়া প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের আমলে সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনের মুদ্রাস্ফিতী ১০ শতাংশ পেরিয়েছে। এদিকে সে দেশের ফুড ফাউন্ডেশন বলছে, ব্রিটেনে জীবনযাত্রার সংকট গভীর হওয়ায় সেপ্টেম্বর মাসে প্রত্যেক পাঁচটি নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে অন্তত একটি পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এএফপি বলছে, সংকটের কারণে লাখ লাখ ব্রিটিশ নাগরিকের খাবার কমানোর তথ্যটি সামনে এনেছে ভোক্তা অধিকার গোষ্ঠী ‘হুইচ?’। তারা বলছে, মানুষের সাধারণত তিনবেলা খাবার খাওয়ার কথা থাকলেও জীবনযাত্রার সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের অর্ধেক পরিবার এখন খাবারের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।
এছাড়া একই পরিমাণ পরিবার অর্থনৈতিক সংকটের আগের তুলনায় স্বাস্থ্যকরভাবে খাওয়া কঠিন বলে মনে করছে। আর এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে আর্থিকভাবে বাধার মুখে পড়ছেন।
কনজিউমার গ্রুপ ‘হুইচ?’ এর ফুড পলিসির প্রধান সুই দাভিস দাবি করেছেন, “জীবনধারনের খরচ বৃদ্ধির খুব খারাপ প্রভাব পড়ছে। খরচ বাড়তে থাকায় হয় লক্ষাধিক মানুষ অর্ধাহারে থাকছে অর্থাৎ একবেলা খাবার খাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার চাহিদামতো পুষ্টিকর খাবার জোগার করতে পারছে না।”
অন্যদিকে, জ্বালানি নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়েছে ব্রিটেনে। সবমিলিয়ে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সবার আগেই কর্পোরেট ট্যাক্স কমান ট্রাস। প্রসঙ্গত, ক্ষমতায় থাকাকালীন এই কর বাড়ানোর পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন ঋষি। কিন্তু ট্রাসের করছাড়ের ঘোষণা করার পরেই বিশ্ববাজারে ঐতিহাসিকভাবে কমে যায় পাউন্ডের দাম। তাছাড়াও, সাধারণ মানুষের কর কমানোর কোনও ঘোষণা করেনি ট্রাসের সরকার। ফলে প্রশ্ন উঠে যায় তার নীতি নিয়ে। এরমধ্যেই প্রকাশ্যে এল এই সমীক্ষার রিপোর্ট। যা নিসন্দেহে ব্রিটেনের সরকারের উপর আরও চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ