ইসলামিক স্টেটকে(আইএস) সিরিয়ায় ব্যবসা পরিচালনার জন্য অর্থ দিয়েছিল ফ্রান্সের সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাফার্জ। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে আইএসের হাতে ৬০ লাখ ডলারের মতো অর্থ তুলে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবসা চালিয়ে যেতে একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার অঙ্গসংগঠনসহ সিরিয়ায় অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও অর্থ দিয়েছিল।
আইএসকে অর্থ দেয়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিন শহরের একটি আদালত ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ৭৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা করে।
সিরিয়ায় যখন ইসলামিক স্টেটের তাণ্ডব চলছে, তখন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পুরোদমে ব্যবসা চালায় প্রতিষ্ঠানটি। যদিও ঝুঁকির মুখে সে সময় দেশটি থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
আইএসকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সিরিয়ায় লাফার্জের সিমেন্ট উৎপাদন চালিয়ে যেতে ইসলামিক স্টেটের নেতাদের অর্থ দিয়েছিলেন তারা।
এর আগে ফ্রান্সের আদালতে লাফার্জের আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন, অর্থ দেওয়ার পেছনে জঙ্গি সংগঠনটিকে সহায়তার কোনো সংকল্প ছিল না প্রতিষ্ঠানটির।
জঙ্গিদের অর্থ দেওয়াসংক্রান্ত কিছু গোপন নথি ২০১৮ সালে প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ফ্রান্সের আদালতের ওই নথিতে দেখা যায়, আইএসকে সরাসরি অর্থ দেয়নি লাফার্জ। এ কাজে তারা সহায়তা নিয়েছিল তৃতীয় পক্ষের।
যুক্তরাষ্ট্রেও লাফার্জের বড় ব্যবসা রয়েছে। আইএসকে অর্থ দেওয়ার বিষয়ে লাফার্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজদারি আইনে মামলা চলছিল। ওই আইন অনুযায়ী, দেশটির কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা পাওয়া ব্যক্তি ও সংগঠনকে সহযোগিতা করতে পারবে না কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সেই মামলায় জরিমানার মুখে পড়তে হলো লাফার্জকে। এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তার দায়ে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠাকে এত বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার লাফার্জের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইএসকে অর্থ দেওয়ার সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তারা বর্তমানে লাফার্জ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত নেই। তারা যা করেছিলেন, তা লাফার্জের আচরণবিধির ঘোরতর লঙ্ঘন ছিল। তবে তাদের ওই কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নিয়েছে লাফার্জ।
সিরিয়ায় লাফার্জের সিমেন্ট উৎপাদন চালিয়ে যেতে ইসলামিক স্টেটের নেতাদের অর্থ দিয়েছিলেন তারা।
লাফার্জ কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ঘটনার জন্য তারা ‘গভীরভাবে অনুতপ্ত’ এবং ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায় স্বীকার করছে’।
লাফার্জ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক হোলসিম গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে এটি মূল কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়। ৬৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ তুরস্ক সীমান্তের কাছে জালাবিয়াতে তার প্ল্যান্ট চালু করেছিল।
মার্কিন কৌঁসুলিরা বলছেন যে, লাফার্জ ইসলামিক স্টেট ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল নুসরা ফ্রন্টকে ৫ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করে। লাফার্জ অবশেষে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সেই প্ল্যান্টটি বন্ধ করে, যখন আইএস শহর এবং কারখানার নিয়ন্ত্রণে নেয়।
মার্কিন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল লিসা মোনাকো বলেন, কোম্পানির এই কর্মকাণ্ড ‘কর্পোরেট অপরাধকে প্রতিফলিত করে যা খুব অন্ধকার জায়গায় পৌঁছেছে’। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ব্যবসা স্বাভাবিক হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এক বিবৃতিতে মূল কোম্পানি হোলসিম বলেছে, তাদের কেউই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তারা কখনও সিরিয়ায় কাজ করেনি।
এরিক ওলসেন, যিনি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সিইও ছিলেন। সিরিয়ায় লাফার্জের কার্যক্রমের তদন্তের পর পদত্যাগ করেন তিনি। সেই সময় ওলসেন বলেন যে, তিনি কোনও অন্যায়ের সাথে জড়িত ছিলেন না।
জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার পাশাপাশি ইসলামিক স্টেট (আইএস) বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন। শুরুতে এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল)। ২০১৩ সালের এপ্রিলে এর প্রতিষ্ঠা হয়। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আইএস।
২০১৪ সালের জুনে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখলে নিয়ে কথিত খিলাফতের ঘোষণা দেয় আইএস। সিরিয়ার রাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে। পাশের ইরাকের মসুল শহরকে ঘোষণা করে দ্বিতীয় রাজধানী। এরপর প্রায় তিন বছর ধরে পুরো অঞ্চলে হত্যা, নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ ৭৯টি দেশের পাশাপাশি সিরিয়ার সরকারি ও বিদ্রোহীসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর বহুমুখী আক্রমণে আইএস পর্যুদস্ত হয়। ২০১৭ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের স্বঘোষিত ‘খিলাফত’-এর পতন ঘটে। তবে গোষ্ঠীটি আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সক্রিয় রয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনমতে, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রথম কোনো কোম্পানি হিসেবে আইএসকে আর্থিক সহায়তার অভিযোগ স্বীকার করল লাফার্জ। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্যারিসে মামলা চলছে। অভিযোগ, ২০১১ সালে সিরিয়ায় সংঘাত শুরু হওয়ার পরও দেশটিতে একটি কারখানা চালু রেখেছিল লাফার্জ। তবে মানবতাবিরোধী অভিযোগ অস্বীকার করেছে কোম্পানিটি।
২০১৭ সালে লাফার্জের বিরুদ্ধের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে ফ্রান্সের একাধিক অধিকার গোষ্ঠী। তারা জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসসহ সিরিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ ডলার অর্থসহায়তা দেয় ফরাসি কোম্পানিটি। এরপর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ