বাংলাদেশে গ্রিড বিপর্যয়, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ অন্তত পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন। একমাসের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয় বিপর্যয়।
মঙ্গলবার দুপুর দুইটা বেজে চার মিনিট নাগাদ গ্রিড বিপর্যয় হয়। জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ চরম কষ্টের মধ্যে পড়েন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ঢাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা ছিল অন্ধকারে।
যারা জেনারেটর দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলেন, তাদেরও অনেকের তেল ফুরিয়ে যায়। এর ফলে পানির সংকট দেখা দেয়। এটিএম থেকে টাকা তোলা যাচ্ছিল না। আলো জ্বলছিল না। অন্ধকারে ঢেকে যায় শহর থেকে গ্রাম।
বেড়েছে লোডশেডিং
বিদ্যুতের পূর্বাঞ্চল জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর এর সঙ্গে সংযুক্ত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করতে দুই দিনের বেশি সময় লেগে গেছে। এতে দেশজুড়ে বেড়েছে লোডশেডিং।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই থেকে শুরু হওয়া লোডশেডিংয়ের মাত্রা কিছুটা কমে এসেছিল। গ্রিড বিপর্যয়ের পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটা সরবরাহ করা যায়নি। তাই এক ঘণ্টার পরিবর্তে কোথাও কোথাও কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ঢাকাতেও বেড়েছে লোডশেডিং।
তিন দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বারবার লোডশেডিংয়ে পড়ার অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কামরুন্নেছা রুহী জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার (গ্রিড বিপর্যয়ের দিন) টানা ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এরপর দিনে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। প্রতিবারই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং থাকছে।
ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, দিনে ও রাতে ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে। এতে প্রতিটি ফিডারে (নির্দিষ্ট গ্রাহক এলাকা) অন্তত দুবার, কোথাও তিনবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
আর ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী বলেন, লোডশেডিং সহনীয় হয়ে এসেছিল। এখন চাহিদার চেয়ে ২০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। তাই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের শিডিউল (সূচি) মানা যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার (গ্রিড বিপর্যয়ের দিন) টানা ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এরপর দিনে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। প্রতিবারই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং থাকছে।
ঢাকার বাইরে বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) এলাকায় তিন মাস ধরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। কিছুটা উন্নতি শুরু হতেই এখন আবার বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এ সংস্থা। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার চেয়ে ১ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ হচ্ছে। এতে কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। ময়মনসিংহে ৩৫ শতাংশ ও সিলেটে ২০ শতাংশ লোডশেডিং করতে হয়েছে গতকাল।
এখনো কোনো সমাধান নেই
গ্রিড বিপর্যয়ে মঙ্গলবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের বেশ কিছু অঞ্চল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার মূল কারণ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক না করার কারণেই বারবার এ ধরনের বিপর্যয় ঘটছে।
মঙ্গলবারের ব্ল্যাকআউট বিপর্যয় শেষে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ার পরেও তিনদিন ধরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের গ্রাহকরা।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র তদন্ত কমিটি জাতীয় পাওয়ার গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট পরিদর্শন করে।
কমিটির সদস্যরা বিপর্যয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি, তবে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পিজিসিবি-র কয়েকজন কর্মকর্তা আশুগঞ্জে একটি গ্রিড লাইন ওভারলোড হওয়ার কথা জানান। অনেকে অনুমান করেছেন ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটে “ক্যাসকেড ট্রিপিং”-এর কারণে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটে।
গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ জানতে দুই দিন ধরে কাজ করছে পিজিসিবি গঠিত তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অঞ্চল ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
আজ শুক্রবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে তদন্ত কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আরও অনেক তথ্য লাগবে। বিপর্যয়ের সময় পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ পূর্বাঞ্চলে সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এখন। সব তথ্য পাওয়ার পর বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
তবে গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্রিড বিপর্যয় অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এমন কারিগরি ত্রুটি হতেই পারে। এ সময় উৎপাদনের চেয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে পিছিয়ে থাকার কথাও স্বীকার করেন তিনি।
সাধারণত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ভারসাম্য হারালে ক্যাসকেড ট্রিপিং হয়ে থাকে। উৎপাদনের চেয়ে যখন চাহিদা বেশি থাকে তখন জেনারেটরগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি কমে। ফ্রিকোয়েন্সি সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে গেলে পুরো গ্রিড ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। উৎপাদনের চেয়ে যদি চাহিদা কম হয়, সেক্ষেত্রেও ব্ল্যাকআউট বা গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে।
চলতি মাসেই এর আগেও গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। গত ৭ সেপ্টেম্বর গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। তখন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগ-সহ দেশের বিশাল এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল।
তবে এবারের গ্রিড বিপর্যয় ছিল আরো ব্যাপক।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় কমবেশি সব দেশেই হয়। এমনকি উন্নত বিশ্বেও এ নজির আছে। তার যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। তবে আমাদের মতো এমন ঘন ঘন বিপর্যয় তেমন দেখা যায় না। উন্নত বিশ্বে এ রকম পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়ার জন্য আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তি থাকে। তাদের স্মার্ট বা স্বয়ংক্রিয় জাতীয় গ্রিড। কোথাও কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলেই তা দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ফলে খুব বেশি সময় তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৪
আপনার মতামত জানানঃ