চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের সোয়ান্তে প্যাবো। গত সোমবার নোবেল কমিটি তার নাম ঘোষণা করে।
নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শরীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের জিনবিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো। বিলুপ্ত হোমিনদের জিনোম এবং মানবজাতির বিবর্তন বিষয়ে গবেষণার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে প্যাবোকে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় সবচেয়ে সম্মানীয় পুরস্কার নোবেল। Nobel Assembly of Sweden’s Karolinska Institute-এর তরফে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রাপককে দশ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রাউন দেওয়া হয় পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে। এই বছরের নোবেল পুরস্কারের মধ্যে প্রথম ঘোষণা করা হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেলের বিষয়টিই।
কী ছিল তার গবেষণায়
নোবেল কমিটির বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, সোয়ান্তে প্যাবো মানুষের বিলুপ্ত আত্মীয়দের জেনেটিক কোড নির্ধারণের মতো কালজয়ী একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও তার নামের পাশে ডেনিসোভানের মতো চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের কীর্তিও যোগ হয়েছে। তার এই কাজের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব বিবর্তনের ইতিহাস এবং কীভাবে মানুষ এই সুন্দর গ্রহে ছড়িয়ে পড়েছে তা জানা যায়। এই সুন্দর পৃৃথিবীতে আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পূর্বসূরিরা বিলুপ্ত হওয়ার সময় হোমো সেপিয়েন্স কী আমাদের সফল হতে দিয়েছিল? প্রায় সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় তার আবিষ্কার ও গবেষণা থেকে।
১৯৯০-এর দশকে মানুষের জেনেটিক কোড নিয়ে ব্যাপক গবেষণার চলেছিল। কিন্তু সেকালে আদিম মানুষের তাজা ডিএনএ ছিল দুষ্প্রাপ্য। অধ্যাপক প্যাবোর আগ্রহ ছিল মানুষের পূর্ব-পুরুষদের পুরনো, অবনমিত এবং দূষিত জেনেটিক উপাদানের প্রতি।
অনেকেই তার গবেষণার ধরন এবং নমুনা দেখে সেকালে উপহাস করেছিল। কারণ এর আগে কোনো গবেষক এতো পুরনো নমুনা নিয়ে কাজ করতে চাননি। আধুনিক যুগে অধ্যাপকের জন্য এই কাজটি ছিল মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়। এই গবেষণায় নেমে তিনি প্রথমেই ৪০ হাজার বছরের পুরনো হাড়ের টুকরা থেকে ডিএনএ সিকোয়েন্স করে সফল হন। আর হাড়ের ডিএনএ’র গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে, নিয়ান্ডারথালরা বেশিরভাগ ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় বসবাস করতো। তারা আধুনিক মানুষ এবং কথিত শিম্পাঞ্জি থেকে আলাদা ছিল। তার কাজটি থেকে আমাদের বিলুপ্ত পূর্বপুরুষদের পরিচয় কিছুটা হলেও উঠে আসে।
নোবেল কমিটি বলেছে, পূর্বসূরিদের জিনগত পার্থক্য প্রকাশ করে যে, সমস্ত জীবিত মানুষ প্রাচীন মানুষদের তুলনায় আলাদা ছিল। তার এই আবিষ্কারের ফলে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, আধুনিক মানুষ ভিন্নভাবে বেড়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ আরও দেখায় যে ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে আগত মানুষদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মিল ছিল। এটি আমাদেরকে আরও জানায় যে, হোমো সেপিয়েন্সরা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত হয়ে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যৌন সঙ্গমের মধ্যদিয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে। আধুনিক মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ ডিএনএ নিয়ান্ডারথাল পূর্বসূরিদের সঙ্গে মিলে যায়।
যেভাবে সম্ভব হলো
চাবিকাঠি ছিল প্রাচীন মিশরে। নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন নকশা তৈরির যে প্রক্রিয়াটি প্যাবো ব্যবহার করেছেন তা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে তার কৈশোরে। তার বয়স যখন ১৩ তখন তার মা তাকে নিয়ে মিশরে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে। সেখানে তিনি মিশরের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ব দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তখনই সিদ্ধান্ত নেন তিনি ভবিষ্যতে একজন মিশরবিদ হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে সোয়ান্তে প্যাবো ভর্তি হন স্টকহোম থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং সেখানে তিনি ইজিপ্টোলজি বা মিশরবিদ্যায় ডিগ্রি শুরু করেন। যাহোক, দু’বছর পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি জীবনে যা চেয়েছিলেন মিশরবিদ্যা তা নয়। এই বিভাগে পড়াশুনার প্রধান ঝোঁক ছিল হায়ারোগ্লিফিক ভাষার ব্যাকরণ শিক্ষার দিকে। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন মমি আর পিরামিড আবিষ্কার করবেন।
এই সুন্দর পৃৃথিবীতে আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পূর্বসূরিরা বিলুপ্ত হওয়ার সময় হোমো সেপিয়েন্স কী আমাদের সফল হতে দিয়েছিল? প্রায় সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় তার আবিষ্কার ও গবেষণা থেকে।
এবিষয়ে বছর কয়েক আগে প্যাবো বিবিসিকে বলেছিলেন, “আমি যা ভেবেছিলাম এটা মোটেও তেমন রোমান্টিক কিংবা ইন্ডিয়ানা জোনস টাইপের ব্যাপার ছিল না।”
এই কারণেই তিনি ইজিপ্টোলজি ছেড়ে শুরু করলেন মেডিসিন পড়া। এরপর তিনি মলেকিউলার জেনেটিক্সে ডক্টরেট করেন। আর এর মধ্য দিয়েই কৈশোরে তার যে বিষয়কে ঘিরে তার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সেই বিষয়কে তিনি তার পেশার ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত করতে পেরেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস প্যাবোর ওপর যে প্রোফাইল প্রকাশ করেছে তাতে তিনি লিখেছেন, “আমি বুঝতে শুরু করলাম যে ডিএনএ ক্লোন করার জন্য আমাদের কাছে অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি কেউ প্রত্নতাত্ত্বিক দেহাবশেষ – বিশেষ করে মিশরীয় মমিগুলির ওপর প্রয়োগ করেছে বলে মনে হয় না।”
ফলে এই পথ ধরে তিনি তৈরি করতে পারবেন, বলা যায়, তার নিজস্ব জিনোমিক টাইম মেশিন। বিষয়টি নিয়ে তার প্রবল উৎসাহ তাকে টেনে নিয়ে গেল মমির ডিএনএ অধ্যয়নের দিকে। এর কয়েক বছর পর তিনি চলে যান ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলেতে প্রাচীন ডিএনএ অনুসন্ধান নিয়ে গবেষণার জন্য।
এরপর এই গবেষণার ধারায় তিনি চলে যান জার্মানির মিউনিখে, যেখানে গুহাবাসী ম্যামথ এবং মেরু ভল্লুকের গবেষণায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।
কাজটা সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। সময়ের সাথে সাথে তিনি আরও অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু করার জন্য প্রস্তুত হন: অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএ রহস্য উন্মোচন এবং বর্তমানের আধুনিক মানুষের থেকে নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন বিন্যাস কতখানি আলাদা তা ব্যাখ্যা করা। তিনি হয়তো তখন ভেবে দেখেননি, কিন্তু তার হাত ধরেই বিজ্ঞানে চালু হয়েছিল নতুন একটি শাখা: প্যালিওজেনোমিক্স।
ডেনিসোভান গবেষণা
মানুষের উৎপত্তি নিয়ে আগের সবচেয়ে সফল আবিষ্কার হয়েছিল ২০০৮ সালে। বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো আঙুলের হাড় খুঁজে পেয়েছিলেন। অধ্যাপক প্যাবো সেখানকার একটি ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি ওই নমুনা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে, এটি একটি অজানা হোমিনিন যা ডেনিসোভান নামে পরিচিত। পরে তিনি দেখতে পান যে, হোমো সেপিয়েন্সরা ওই ডেনিসোভানদের সাথেও বংশবিস্তার করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশের আধুনিক মানুষদের মধ্যে ৬ শতাংশ মানুষের ডিএনএ-এর সাথে ডেনিসোভানদের মিল রয়েছে।
প্যাবো বিবিসিকে বলেন, আমরা যখন নমুনাগুলি বিশ্লেষণ করেছি তখন লক্ষ্য করেছি যে প্রায়ই আমরা এমন হাড়ের টুকরোগুলিতে বেশি সাফল্য পেয়েছি যেগুলিতে কাটা দাগ ছিল কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে যে হাড়গুলিকে ভাঙা হয়েছিল। জীবাশ্মবিদদের মতে, এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে এই মানুষগুলিকে খেয়ে ফেলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “আপনি যদি হাড়ের এই সামান্য টুকরোগুলো থেকে মাংসকে আলাদা করে খেয়ে ফেলেন এবং হাড়গুলো গুহার কোণে ফেলে দেন, তাহলে সেখানে তারা দ্রুত শুকিয়ে যাবে এবং হাড়গুলোর মধ্যে মাইক্রোবিয়াল তৎপরতা কম হবে।। এবং এগুলো অনেক দ্রুত শুকিয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নিয়ান্ডারথাল প্রকল্পের সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় এসব নরখাদকদের।”
এই কাজে প্যাবো আধুনিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এবং উঁচু মানের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য এমন পরীক্ষাগার তৈরি করেন যেটি নমুনাগুলিতে দূষণ রোধ করতে পারে। এরপর তিনি লক্ষ লক্ষ ডিএনএ খণ্ড বিশ্লেষণ করেন এবং পরিসংখ্যানগত কৌশল ব্যবহার করে দূষণ সৃষ্টিকারী আধুনিক জিন থেকে সেগুলোকে আলাদা করেন।
যাই হোক, সোয়ান্তে প্যাবোর এই আবিষ্কার আমাদের পূর্বসূরি সম্পর্কে আগের চেয়েও বেশি ধারণা দেয় বলেই তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে তিনি এক কোটি সুইপিশ ক্রোনার পাবেন। আশা করা যায় তার গবেষণা আরও বিস্তৃতি লাভ করবে যাতে করে ভবিষ্যতে আমরা জানতে পারবো, কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়া হয়ে হিমশীতল সাইবেরিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৩
আপনার মতামত জানানঃ