আজ ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর চার বছর পূর্ণ হয়েছে। গত চার বছরে সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে এ আইনের ব্যবহার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে।
সাইবার অপরাধ দমনে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন করা হয়। ওই আইনের ৫৭ ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দিলেও পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে উল্টো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নামে আরও কঠোর আইন করে। সময়ের হিসেবে আজ শনিবার এই আইনের চার বছর পূর্ণ হলো। সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা শুরু থেকেই এই আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার লেখক মোশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। একই মামলায় কার্টুনিস্ট কিশোরও বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন।
এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ হলে সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগের কথা জানায় যদিও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
তবে চলতি বছর মে মাসে পাবলিক প্রসিকিউটরদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যদি কোনো মামলা হয়, তাহলে দয়া করে সরকারি কৌঁসুলিরা যেন আগে খুঁজে বের করেন যে ওইটা আদৌ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হওয়ার মতো কি না। না হলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে তিনি তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ওইদিনই তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে বলেছেন যে এ আইনে মামলা হলেই যেন সাথে সাথে গ্রেফতার না করা হয়।
যদিও এরপরেও এ আইনে মামলার পরপরই গ্রেপ্তারের নজির আছে।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের বিস্তার ঘটছে। এটি দমনে যেমন আইন দরকার, তেমনি এর যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সুশীল সমাজ মনে করছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। এই আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করলেই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে। দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব মামলা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কী, কী আছে এ আইনে
আইনটি প্রস্তাবের পর থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কর্মীরা। তাদের আশঙ্কা, আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে। আইনে বলা হয়েছে:
• ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোন তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।
• আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয় বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
যারা আসামি, যারা বাদী
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কটূক্তির অভিযোগেও এ আইনে মামলা হয়েছে।
তবে এটি সত্যি যে আইনটি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও শোরগোলের প্রেক্ষাপটে চলতি বছর এ আইনে তুলনামূলক কম মামলা হয়েছে।
সরকারের ব্যক্তিদের সুরে কথা না বললে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলা হচ্ছে। উচ্চ স্তরে থাকা ওই ব্যক্তিদের এ ধরনের প্রবণতা নিচের দিকে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও রপ্ত করছেন।
চলতি বছর অগাস্ট পর্যন্ত এই আইনে ৭৯টি মামলা হয়েছে যাতে আসামী ১৭১ জন। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৪৬জন।
এর মধ্যে ৫৩টি মামলাই হয়েছে ফেসবুকে বা অনলাইনে মত প্রকাশের কারণে। এর মধ্যে আটটি মামলা করেছে পুলিশ ও র্যাব। আর সরকারি দল সংশ্লিষ্টরা মামলা করেছে ৪৩টি।
এর মধ্যে ২৫টিই হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাদের নিয়ে মন্তব্যের কারণে। চলতি বছর সতেরটি মামলায় ৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। আর জেলে গেছেন পাঁচ জন।
এর আগে ২০১৮ সালে ৩৪টি, ২০১৯ সালে ৬৩টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি ও ২০২১ সালে ২৩৮টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬১১ টি মামলা হয়েছে গত চার বছরে এবং বিভিন্ন মামলায় গত তিন বছরেই মোট ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে।
বাদ যায়নি শিশুরাও
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি ছড়ানো, ধর্ম অবমাননা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার অভিযোগেও অল্প বয়সীদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ২০ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ১২ জেলায় ১৮টি মামলার কথা জানা গেছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ হিসাব দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক। তারা বলছে, মামলাগুলো করেছেন সরকারদলীয় লোকজন, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যক্তিরা। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে এই শিশু–কিশোরদের পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ লাখ থেকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
তৈরি হয়েছে ভয়ের পরিবেশ
আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে।
সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, সরকার সমালোচনায় ভীত হয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটি করেছিলো এবং দেশে এখন সেই পরিবেশই তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
এদিকে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম কর্মীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই সরকার এমন আইন করেছে। তবে এসব অপরাধের বিচারে প্রচলিত আইনই যথেষ্ট।
সম্প্রতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনা সভায়
অংশ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জনগণের স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থে করা হয়েছে। আইনে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে অপব্যবহার করার জন্য। আইনটি বাতিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন না করলে প্রতিকার পাওয়া যাবে না। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এই আইনের মাধ্যমে রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে এবং অপপ্রয়োগ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, আইনের দোষ নয়, দোষ আইন প্রয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গির। আইনটির নানাভাবে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। আলোচনার ভিত্তিতে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানি—এই তিনটির মতো অস্পষ্ট বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারের ব্যক্তিদের সুরে কথা না বললে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলা হচ্ছে। উচ্চ স্তরে থাকা ওই ব্যক্তিদের এ ধরনের প্রবণতা নিচের দিকে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও রপ্ত করছেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। মামলার ভয়ে সবকিছুতে এখন আত্মনিয়ন্ত্রণ চলছে। সাংবাদিকেরা আত্মনিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেন। সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালনে, পেশাদারত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হলেন কি না, আইনটি কার স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
তিনি আরও বলেন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে বাতিল করা গিয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেও একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিন–এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আরও কিছু আইন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করছে। ব্রিটিশ আমলের আইন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এ পর্যন্ত দুজন সাংবাদিকের ওপর অপব্যবহার করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এরপর আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন রোজিনা ইসলাম। সীমান্তের বাইরে থেকে এক সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করায় তার বোনকে ধরে আনা হয়েছে, যা আইনসংগত নয়। এসব আইন নাগরিকের অধিকার ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে অপব্যবহার হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যক্ষ করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৫
আপনার মতামত জানানঃ