নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুর করায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় সোহাগ আলী নামে এক আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। সেই সঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলেও রায়ে জানানো হয়।
মঙ্গলবার সকালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক সাবিনা ইয়াসমিন এ রায় ঘোষণা করেন। আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, মামলার আসামি সোহাগ পলাতক। ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর সোহাগ আলী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসের সামনের শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে রেখে ভাঙচুর করে ও দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে।
স্থানীয়রা তা দেখে ছুটে গিয়ে তাকে আটক করে ও মারপিট করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তাকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় উপজেলা পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর আশরাফুল ইসলাম সোনারগাঁও থানায় ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করেন। সে মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য শেষে আদালত আজ এ রায় ঘোষণা করেন।
এদিকে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কথা বলায় কথিত কটূক্তির অভিযোগে তাওহীদ ইসলাম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি)।
সিটি ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের সাইবার ইন্টেল টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) অমিত কুমার দাশ বলেন, বিভিন্ন অনলাইন মনিটরিং করার সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি আইডি থেকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সুনাম ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও দেশের বিভিন্ন সংবেদনশীল ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে এমন মন্তব্য করা পোস্ট চোখে পড়ে। তখন এটি নিয়ে কাজ শুরু করে সিটি সাইবার পুলিশ।
এদিকে, ২০২০ সালে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে “অবমাননাকর” পোস্ট করায় ১৫ বছরের এক শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার উত্তরে ভালুকায় পুলিশ গনমাধ্যমকে জানায় তারা শিশুটিকে গ্রেপ্তার করেছিল যখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করে ছেলেটি “আমাদের মায়ের মত নেত্রীকে … অপবাদ” দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করায় কাউকে গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন নয়, সর্বশেষ উপায় ছাড়া ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে আটক করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। তবুও গ্রেফতার করা হয় ওই কিশোরকে।
চলতি বছর জানুয়ারিতেই আওয়ামী লীগের ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে এক তরুণকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর একটি আদালত।
একজন আওয়ামী লীগ নেতার করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার এই মামলার রায়ে একই সঙ্গে ওই যুবককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই গুরুদণ্ড এবং রাজনৈতিক বিতর্কসহ সবকিছু আদালতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ব্যক্তির মানহানি হলে আইন অনুযায়ী মানহানি মামলা হয় কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো প্রতিষ্ঠান। এ মামলায় আওয়ামী লীগের মানহানি হলে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ কিন্তু তা হয়নি।
তিনি বলেন কিছু বিষয় আছে যেগুলো রাজনীতি ও সংবিধানের সাথে জড়িত৷ সেগুলো অনেক সময় আদালতে আসে জাতীয় স্বার্থে। কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রচার-পাল্টা প্রচার, কুৎসা-পাল্টা কুৎসা এগুলো তো আদালতে বয়ে আনার যুক্তি নেই৷ এসব বিষয়ে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স যারা করবেন তাদের শক্তভাবে এগুলো দেখা উচিত।
দণ্ডপ্রাপ্ত তরুণের নাম আবদুল মুকিত ওরফে রাজু (২২)। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের ছেলে। ২০১৭ সালে মামলাটি করেছিলেন হরিপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান বাদল৷ মুকিত হরিপুর ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সভাপতি বলে দাবি সাইদুর রহমানের।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ মে আবদুল মুকিত তার ফেসবুক আইডিতে আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করে বাবা ও ছেলের কথোপকথনের ঢঙে একটি কৌতুক পোস্ট করেন৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী শব্দটি আইয়াম শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর লীগ অর্থ দল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মানে অন্ধকারের দল৷ সেখানে ইসলাম ও আওয়ামী শব্দটি নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থানে এনে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বাদির।
মূলত, একটি স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ এই স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ সেই আলোচনা নিয়েই আছে। স্বাধীনতা অর্জন করেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে কখনো বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করতে পারেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৬
আপনার মতামত জানানঃ