হিজাব আইন ভঙ্গের অভিযোগে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর হাসপাতালে মারা গেছেন ২২ বছর বয়সী নারী মাহশা আমিনি। এই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড় বইছে। খবর আল-জাজিরা, গার্ডিয়ানের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহশা আমিনি ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কুর্দিস্তান থেকে আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে পরিবারসহ রাজধানী তেহরানে যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে কট্টর পোশাকবিধি ভঙ্গের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পুলিশ ভ্যানে তোলার পর আমিনিকে মারধর করা হয়। তবে ইরানি পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
নারীদের পোশাক নিয়ে ইরানের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির কড়াকড়ি বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মাথায়ই এ ঘটনা ঘটে। ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানে নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হয়।
ইরানি মানবাধিকার সংস্থা হ্রানা জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ বলেছিল ‘পুনঃশিক্ষা সেশনের’ পর আমিনিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টা পর মাহশা আমিনি হাসপাতালে ভর্তি হয় বলে ওই তরুণীর পরিবারকে জানানো হয়। আমিনিকে কাসরা হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল।
Islamic Republic killed this woman to enforce hijab.
After days in a coma, source said “Mahsa Amini, 22, died today”.
She was beaten up by morality police because of wearing “bad hijab”.
Iranian women are outraged. Forced hijab is the main pillar of religious dictatorship. pic.twitter.com/51EyYwB8iX
— Masih Alinejad 🏳️ (@AlinejadMasih) September 16, 2022
ইরান পুলিশের দাবি, আটক থাকা অবস্থায় মাহসা ‘হার্টের সমস্যায়’ ভুগছিলেন। তবে পুলিশের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশের মারধরেই মৃত্যু হয়েছে ওই তরুণীর।
মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল ১৯-এর ডিজিটাল-অধিকারবিষয়ক গবেষক মাহসা আলিমারদানি টুইটারে লিখেছেন, তেহরানের পুলিশ ঘোষণা করেছে যে, মাহসা আমিনি হঠাৎ হার্টের সমস্যায় পড়েন। তারা এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করছে যেন মাত্র ২২ বছরের এক তরুণীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে যা স্বাভাবিক। এটিই যেন তাকে কোমায় নিয়ে গেছে। আর ইরানি মিডিয়া এ অসত্য দাবিকে সত্য হিসেবে প্রকাশ করছে।’
তবে পুলিশের দাবি নাকচ করে আমিনির পরিবার বলছে, তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন এবং তার কোনো শারীরিক সমস্যাও ছিল না। হাসপাতালে আমিনিকে কোমায় রাখা হয়েছিল। হাসপাতালে আমিনির মাথায় ব্যান্ডেজ এবং মুখে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বসানো ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিন্দা জানিয়েছে। সেইসঙ্গে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ২২ বছর বয়সী তরুণী মাহশা আমিনির পুলিশ হেফাজতে সন্দেহজনক মৃত্যুর অবশ্যই ফৌজদারিভাবে তদন্ত করা উচিত। পুলিশ হেফাজতে তিনি নির্যাতন এবং অন্যান্য বাজে আচরণের মুখোমুখি হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার মাশাকে গ্রেপ্তারের খবর শুনেই থানায় ছুটে যান তার ভাই কিয়ারেশ। গোটা ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী কিয়ারেশ ইরানের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইরান ওয়্যারকে বলেন, ‘থানায় পুলিশ কর্মকর্তাদের আমার বোনকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মিনতি জানাই। তারা আমাকে জানান, মাহশাকে গাশত-ই এরশাদের (হিজাব না পরা) আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তারা আমাকে থানার বাইরে অপেক্ষাও করতে বলেন।’
‘সেইমতো আমি থানার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম, কিছুক্ষণ পরই একটি অ্যাম্বুলেন্সকে থানার সামনে এসে থামতে দেখলাম। তারপর দেখলাম থানার ভেতর থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য কাউকে পাঁজাকোলা করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যাকে এইমাত্র অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো, সে আমার বোন মাহশা। থানার কমর্ককর্তারা বললেন, হেফাজতে থাকার সময় তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছে। সময় হিসেব করে দেখলাম, থানায় নিয়ে আসার মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে মাশাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে।’
ইরানের মর্যালিটি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবেন উল্লেখ করে ইরান ওয়্যারকে কিয়ারেশ বলেন, ‘আমার আর এখন হারানোর কিছু নেই। তাদের (মর্যালিটি পুলিশ) কাউকে ছাড়ব না আমি।’
এদিকে, শুক্রবার মাশা আমিনির মৃত্যুর পর একটি বিবৃতি দিয়েছে তেহরান পুলিশ। সেখানে বলা হয়েছে, ইরানে নারীদের পোষাকবিধি সম্পর্কে ‘ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা’ দিতে মাহশাকে হেফাজতে নেয়া হয়। ‘কিন্তু থানা হেফাজতে আসার পর আকস্মিকভাবে তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা শুরু হয়, সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের উদ্যোগে তাকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়,’ বিবৃতিতে উল্লেখ করে তেহরান পুলিশ।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তেহরান পুালিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম; কিন্তু কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে মাহশা আমিনি মৃত্যুতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এই ঘটনাটি যথাযথভাবে তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ