গত ২৩ আগস্ট কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যান কুমিল্লার সাত শিক্ষার্থী। যাওয়ার সময় তেমন টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন কিংবা বাড়তি পোশাকও নেননি তারা। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলেও নিখোঁজ প্রত্যেকেই ছিলেন পরস্পরের পরিচিত। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
স্বজনদের দাবি, পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো বিশেষ বিষয়ের প্রতি কখনও তারা সন্তানদের আগ্রহ দেখেননি। কলেজ, কোচিংয়ের বাইরে যে সময়টি পেতেন তার বেশির ভাগটাই বাসায় বই পড়ে কিংবা মোবাইল ফোনে তারা সময় কাটাতেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর পুলিশ ধারণা করেছিল, তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
এদিকে সাত কলেজছাত্র নিখোঁজের ঘটনায় হোতাকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)।
রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে বুধবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিটিটিসির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, গ্রেপ্তার শাকির বিন ওয়ালী একজন চিকিৎসক৷ তিনি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য।
তিনি জানান, শাকির কুমিল্লার নিখোঁজ সাত ছাত্রকে আনসার আল ইসলামে যোগদান করান। তিনি ওই সাতজনকে তাওহিদ ও জিহাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
ওই সাত ছাত্রের খোঁজ এখনও মেলেনি বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির প্রধান।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) আবদুল মান্নান এই শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে, তবে তাদের সন্ধান পাওয়ার আগে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা হলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান, সামি, কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম, নিহাল, ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত, একই কলেজের তৃতীয় বর্ষের আমিনুল ইসলাম আলামিন ও ঢাকার ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স শেষ করা নিলয়।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ছয় বছর পর আবারও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণদের ঘর ছাড়ার প্রবণতাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন জঙ্গিবাদবিষয়ক বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ, হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত জঙ্গিরাও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এভাবে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
শাকির কুমিল্লার নিখোঁজ সাত ছাত্রকে আনসার আল ইসলামে যোগদান করান। তিনি ওই সাতজনকে তাওহিদ ও জিহাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
তবে হোলি আর্টিজানের হামলার আগে যারা বাড়ি ছেড়েছিলেন, তারা ছিলেন মূলত নব্য জেএমবির সদস্য। যারা নিজেদের আইএস (ইসলামিক স্টেট) দাবি করতেন। আর এবার নিখোঁজ তরুণেরা আনসার আল ইসলামের সদস্য, যারা নিজেদের আইকিউআইএসের (আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখা) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে।
সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণরাও আফগানিস্তানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বাড়ি ছাড়েন বলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। জঙ্গি দমনে কাজ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে নিখোঁজ এই তরুণদেরও দেশের ভেতরে কোনো না কোনো আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও শঙ্কা এখনও আনসার আল ইসলামকে নিয়ে। আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) হিসেবেও বলা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনের সহিংস কর্মকাণ্ড না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হওয়ার কাজ করছে। তারা যদি আবারও সহিংস কর্মকাণ্ডে ফিরে আসে তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। এই দলের সদস্যরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। এই দলের শীর্ষ নেতা পলাতক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াও অনেক বেশি প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন। ফলে সংগঠনের সদস্যদেরও সে সেভাবেই তৈরি করেছে। একসময় সেনাবাহিনীর চৌকস কমান্ডো অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা জিয়া নিজের দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে তার সদস্যদেরও অনেক বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করছে।
আনসার আল ইসলাম আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৫ সালের ২৬ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংগঠনের টার্গেট গ্রুপ হলো ব্লগার, নাস্তিক, সেক্যুলার, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগানের বাসায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএস এইড কর্মকর্তা ও সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয়কে হত্যার পর এই সংগঠনকে আর কোনও সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যায়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম সাংগঠনিকভাবে এখন সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সদস্য সংগ্রহ, সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও সংগঠিত করার কাজ করছে। আগে তারা ‘টার্গেটেড কিলিং’ পরিচালনা করলেও ভবিষ্যতে আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের উগ্র মতাদর্শী তরুণদের মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। আল–কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি মারা যাওয়ার পর আল–কায়েদা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার যে চেষ্টা করছে, তাতে উগ্রবাদী এই তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হয়। এই অস্থিরতার কারণে তরুণদের মধ্যে নতুন করে হিজরতের প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তালিবান পুনরুত্থানের জায়গাতে আমরা দেখছি যে আমাদের দেশের জঙ্গিদের একটি অংশ আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে সহযোগিতা বা পৃষ্টপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদকে আবার উজ্জীবিত করা যায় কিনা। তো এখানে যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হবে, তেমনি আমাদের আঞ্চলিক যে ভূ-রাজনীতি আছে, সেটাকেও প্রভাবিত করার জন্য এ শক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি শঙ্কার কারণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ