জীবিত থাকতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মিথ’। ‘মাই নেম ইজ গওহরজান’, গান শেষ হওয়ার পর এই কণ্ঠ শুনেই বুঁদ হয়ে যেতেন শ্রোতারা। তার রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তিনি কিংবদন্তী। তাকে নিয়ে চলে নিত্য নতুন গবেষণা। আর তার গাওয়া গানের পুরনো রেকর্ডগুলি আজও কালেক্টর্স আইটেম। তিনি গহরজান, কলকাত্তাওয়ালি।
২৬ জুন ১৮৭৩ সালে ভারতের আজমগড়ে এক ইহুদি পরিবারে গওহর জানের জন্ম। বাবা মায়ের দেওয়া নাম ছিল অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড। তার দাদি ছিলেন হিন্দু, দাদা ব্রিটিশ। তিনি ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। অ্যাঞ্জেলিনার শিশু বয়সেই তার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তার মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস শিশু অ্যাঞ্জেলিনাকে নিয়ে বেনারসে চলে আসেন এবং সেখানে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
১৮৮০-র দশকের শেষের দিকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে গওহরের মঞ্চ অভিষেক হয়। তারপর জলসায়, রাজসভায়, সমাবেশে গান পরিবেশনের ব্যাপক ব্যস্ততা শুরু হয় তার। কিন্তু তখনও নামের সঙ্গে সুপার স্টার শব্দটি যোগ হয়নি। ১৯০২ সালে, কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম রেকর্ড গওহরের কণ্ঠে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই তার গানের রেকর্ড নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। প্রায় প্রতিটি রেকর্ডের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তা সংগীত মহল থেকে শুরু করে সবার জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
গওহর জানের নামের সঙ্গেই নারী সুপার স্টার শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। তিনিই উপমহাদেশে সংগীতে প্রথম নারী সুপার স্টার।১৯০২ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই ১৮ বছরের সুদীর্ঘ রেকর্ডিং কেরিয়ারে গওহর জান বাংলা, উর্দু ও পার্শিয়ানের পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি, এ্যারাবিক, পুশতো, তামিল, মারাঠি, পেশোয়ারি, গুজরাটি ইত্যাদি প্রায় ২০টি ভাষায় প্রায় ৬০০-র কাছাকাছি গান রেকর্ড করেছিলেন।
১৯০২ সালের ৮ই নভেম্বর কলকাতার এক হোটেলের ঘরের অস্থায়ী স্টুডিওতে গওহর জানের প্রথম গান রেকর্ড করা হয় এবং ১৯০৩ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ ভারতের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো কলকাতার বাজারে চলে আসে। গ্রামোফোনে গান রেকর্ড হওয়া এবং প্রতিটি গানের শেষে নিজকণ্ঠে “মাই নেম ইজ গহর জান” ঘোষণার মাধ্যমে গওহর জানের নাম ভারতীয় সঙ্গীত জগতের শ্রোতাদের মনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে গেল।
‘ভারতের বুলবুল’ গওহর জানের চিৎপুরের বাড়ি জুড়ে দিনেই অনন্ত অন্ধকার। নবসজ্জিত নাখোদা মসজিদের ঠিক পাশে, সাবেক সালেহজি মুসাফিরখানার উল্টো ফুটপাতে বর্তমানে ৯২ নম্বর রবীন্দ্র সরণি! কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটির এক পুরনো বাসিন্দা বলেন, ‘অগুনতি ভাড়াটে গাদাগাদি করে থাকা আখাম্বা বাড়িটায় হাত দিলেই ফ্যাসাদে পড়তে হত! ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটির ঝুঁকি তাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’ সে-দিনের ‘গওহর বিল্ডিং’ নামটা তবু এখনো মুখে-মুখে লেগে আছে!
এমনিতে অবশ্য নাম পাল্টে গিয়েছে পুরনো বাড়ির। ইংরেজি-উর্দুতে লেখা ‘সেলিম মঞ্জিল’। ‘গওহর বিল্ডিং’-শব্দটা! গ্রামোফোন যুগে এ দেশের প্রথম কণ্ঠস্বর ঠুংরি-সম্রাজ্ঞী গওহর জানের কথা জিজ্ঞেস করলে অবশ্য ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে স্থানীয়রা! তারপরে বলবেন, ‘ও আচ্ছা, ‘তবায়েফ’ গওহর জানের কথা বলছেন?’ শতবর্ষ আগে ওই বাড়ির পুরোটাই ছিল গওহরের মালিকানা।
সাফল্যের চূড়ায় বসে তখন তিনি প্রতি-সন্ধ্যায় ছয় ঘোড়ার ফিটনে ময়দানে বেড়াতে বের হতেন। রেশমি পর্দা ঢাকা সেই গাড়ির আদল রথের মতো! জনৈক বাইজির এই ঠাঁটবাটে বিরক্ত হয়ে কোনো ইংরেজ রাজপুরুষ নাকি গওহরকে ১০০০ টাকা জরিমানা করেছিলেন, গওহর সেই টাকা কড়কড়ে নগদে কার্যত তার মুখে ছুঁড়ে মারেন।
তার চালচলনে রাজকীয় একটা ভাব ছিল। টাকা ওড়াতেন ইচ্ছেমতো। আয় করতেন প্রচুর। সেই সময় সাধারণ মানুষের ঘোড়ার গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। অথচ সেই সময়ের ১০০০ টাকা আজকের দিনে কত টাকা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
শোনা যায়, গওহরের পোষ্য বিড়ালের বিয়েতে সে যুগে ১২০০ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বেড়ালের সন্তান লাভে ২০ হাজার টাকায় পুরো শহরকে আপ্যায়ন করেছিলেন বিত্তশালী এই বাইজি।
তবে প্রাক্তন স্বামী আব্বাসের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে চিৎপুরের বাড়িটা একদিন চোখের জলে ছাড়তে হয়েছিল ভারতের এই গানের রানিকে। মহীশূরের রাজার ডাকে শেষমেশ চিরতরে কলকাতাই ছাড়তে বাধ্য হন গওহর। চিৎপুরের মহল্লা জুড়ে অনাদর ও বিস্মৃতির অন্ধকার যেন এখনো সেই ট্র্যাজেডির কথাই বলে বেড়ায়।
‘মাই নেম ইজ গওহর জান’-গান শেষ হওয়ার পর, এই কণ্ঠ শুনেই বুঁদ হয়ে থাকতেন শ্রোতারা। তবে এই নাম শুনলেই রেগে যেতেন তৎকালীণ সমাজপতিরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ