উনিশ শতকের পর আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবী থেকে দাস প্রথার বিলোপ ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে যেভাবে জাহাজ বা ডিঙি নৌকা ভরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেভাবে মানুষ উন্নত দেশের উদ্দেশে ছুটছে তাতে এই অমানবিক প্রথা ফিরে আসার শঙ্কাই প্রবল হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন নতুন চেহারায় দাসপ্রথা প্রায় সব দেশেই বিরাজমান। নতুন রূপটি হচ্ছে শ্রমবাজার ও দাসের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষেরা পুঁজিবাদী ও বাজার অর্থনীতির পৃথিবীর কাঠামোয় আধুনিক দাসে পরিণত হচ্ছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রম অথবা জোরপূর্বক বিয়েতে আটকা পড়েছে। নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক শ্রম অথবা বিয়ে করার এই সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত আধুনিক দাসত্ব প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারি, সশস্ত্র সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকট চরম দারিদ্র্য এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বৃদ্ধি করে মানুষের কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় নজিরবিহীন ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
আইএলওর নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের আধুনিক দাসপ্রথা নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে বাধ্যতামূলক শ্রম অথবা জোরপূর্বক বিয়েতে আটকা পড়া মানুষের সংখ্যা ১ কোটি বেড়েছে।
ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জাতিসংঘের শ্রম ও অভিবাসন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছরের শেষের দিকে ২ কোটি ৮০ লাখ লোক বাধ্যতামূলক শ্রমে বন্দি ছিল এবং ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সমীকরণের মানে দাঁড়ায় বিশ্বের প্রতি ১৫০ জনের মধ্যে প্রায় একজন আধুনিক দাসত্বের শিকার।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রধান গাই রাইডার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আধুনিক দাসত্বের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না এটা খুবই মর্মান্তিক। মানবাধিকারের এই মৌলিক অপব্যবহারের অধ্যবসায়কে কোনো কিছুই ন্যায্যতা দিতে পারে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে এবং অনেক শ্রমিকের জন্য ঋণের মাত্রা বাড়িয়েছে, ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। জোরপূর্বক শ্রমে বন্দি রাখার বিষয়টি বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে এবং জোরপূর্বক বিবাহ প্রায়শই ‘আজীবন কারাদণ্ড’-এর ন্যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাবে কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় অভূতপূর্ব ব্যাঘাত, চরম দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং জোরপূর্বক ও অনিরাপদ অভিবাসনের মতো ঘটনা বেড়েছে।
সতর্ক করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। জোরপূর্বক শ্রমে বন্দি রাখার বিষয়টি বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে এবং জোরপূর্বক বিবাহ প্রায়শই ‘আজীবন কারাদণ্ড’-এর ন্যায়।
বাধ্যতামূলক শ্রমের ফাঁদে আটকে পড়া প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একটি শিশু। অর্ধেকের বেশি শিশু বাণিজ্যিক যৌন দাসের মতো কাজের শিকার। অপরদিকে অভিবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক শ্রম বন্দি থাকার সম্ভাবনা অ-অভিবাসী প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর প্রধান আন্তোনিও ভিতোরিনো বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই প্রতিবেদনটি সমস্ত অভিবাসন নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত তা নিশ্চিত করার জরুরিতার ওপর জোর দেয়।’
আধুনিক দাসপ্রথা মূলত বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রয়েছে। উচ্চ-মধ্যম আয়ের বা উচ্চ-আয়ের দেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ জোরপূর্বক শ্রম এবং এক চতুর্থাংশ জোরপূর্বক বিবাহের শিকার।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের সর্বশেষ বৈশ্বিক অনুমান থেকে জোরপূর্বক বিয়ের শিকার মহিলা এবং মেয়ের সংখ্যা ৬০ লাখ ৬০ হাজারের মতো বেড়েছে।
একই সময়ের মধ্যে জোরপূর্বক শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২০ লাখ ৭০ হাজার। বাধ্যতামূলক শ্রমের মধ্যে ১৪ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আরোপিত কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাধ্যতামূলক সশ্রম কারাদণ্ডের অপব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
উত্তর কোরিয়ায় কঠোর পরিস্থিতিতেও জোরপূর্বক অমানবিক শ্রমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সেইসেঙ্গে চীনের পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বিশেষ করে জিনজিয়াং অঞ্চলের দশ লাখেরও বেশি উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের আটকে রাখার জন্য অভিযুক্ত বেইজিং। সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা সম্ভাব্য জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়ে সতর্ক করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জোরপূর্বক শ্রমের শিকার ব্যক্তিরা সাধারণত পাচার হয়। নির্যাতন বা নির্যাতনের হুমকি, মানসিকভাবে জবরদস্তি, আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার, প্রতারণা বা অন্য কোনোভাবে জবরদস্তি করা হয় তাদের ওপর। অভিবাসীরা এই ধরনের মানব পাচারের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। জোরপূর্বক বা বন্ডেড শ্রমের শিকার নারীরা, বিশেষ করে গৃহস্থালি দাসত্বের নারী ও কিশোরীরা প্রায়ই যৌন নির্যাতন বা শোষণের শিকার হয়।
মানুষ আধুনিক দাসত্বে আটকা পড়ে কারণ তারা প্রায়শই দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার কারণে প্রতারিত, ফাঁদ বন্দী এবং শোষিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এই বাহ্যিক পরিস্থিতিই মানুষকে তাদের পরিবারের ভরণপোষণের সুযোগের সন্ধানে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। অথবা শোষণমূলক কর্মপরিবেশে নিজেদের ঠেলে দেয়।
তারা বলেন, জোরপূর্বক বিয়ে ও বাল্যবিবাহ—যখন কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে এবং আর ছেড়ে যেতে পারে না। বেশিরভাগ বাল্যবিবাহকে দাসত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ