গুলিতে পা গেছে, সেটির তদন্ত হয়নি। উল্টো তার বিরুদ্ধে হয়েছে ছয়টি মামলা। এসব মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে নিত্য হয়রানি আর ভালো লাগে না সাইফুর। বলছেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী ট্যাগ লাগিয়ে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলুক আমাকে।’
লিমনের মতোই কাছ থেকে গুলি করার পর পা কেটে ফেলতে হয়েছে চট্টগ্রামের এক যুবকের। লিমনের ঘটনায় তাও তদন্ত হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের সেই ঘটনায় এক বছরে কোনো তদন্ত হয়নি, উল্টো এক পা হারানো অবস্থায় সেই তরুণকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে ৯ মাস। সম্প্রতি তার মা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এরপর গণমাধ্যমকে সাইফু জানিয়েছেন কীভাবে কী হলো। সাইফুল ইসলাম সাইফু ছাত্রদল করতেন। তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা ছিল ধরে নেয়ার সময়। এখন আছে ২৪টি। তার বিরুদ্ধেও এলাকায় নানা অভিযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলোর প্রমাণ এখনও হয়নি আদালতে। বিচার চলছে।
সাইফুর অভিযোগ, তাকে ধরে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে কাছ থেকে দুইবার গুলি করে পুলিশ। এতে কেটে ফেলতে হয় পা। এরপর তাকে জেলেও পোড়া হয়। ৯ মাস বন্দি থাকার পরও নানা হুমকি দেয়া হয়। বলা হয়, অন্য পা-ও এভাবে যাবে। এ কারণে এতদিন মামলাও করার সাহস পায়নি পরিবার।
তবে সম্প্রতি তার মা মামলা করেছেন। কিন্তু তার অভিযোগের বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিছুই বলতে চাইছেন না। তার দাবি, এটা তদন্তাধীন বিষয়। তাই কথা বলার সুযোগ নেই। অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন, সাইফুকে ধরে নেয়ার পর একটি সশস্ত্র দল আক্রমণ করেছিল। তখন গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
যা ঘটেছিল
তাকে ধরে নেয়ার বিষয়ে সাইফু বলেন, “বায়েজিদ থানার পাশে বাসা হওয়ার সুবাদে পুলিশের সোর্স আকাশের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সে আমাকে রাতে ফোন দেয়, বলে ‘সাইফুল কোথায় তুই, মামলার বিষয়ে কথা আছে, দেখা কর আমার সঙ্গে।’
‘মামলার বিষয়ে বলায় আমি তাড়াতাড়ি গেলাম। যাওয়ার পর ওসি, এসআই মেহের অসীম, এসআই সাইফুল, এসআই তানভীর, এসআই নুর নবীসহ তারা আমাকে ঘিরে ফেলছে। একপর্যায়ে আমার পেটে পিস্তল ঠেকায় দিছে আর মুখে মাস্ক পরায় দিছে। কারণ সেখানে সিসি ক্যামেরা ছিল।’
‘ওসি আমাকে বলল, সাইফুল, বাইরে প্রাইভেট কার আছে, চুপচাপ ওঠ। আমি কোনো কথা না বলে প্রাইভেট কারে উঠলাম। এরপর আমার চোখ-মুখ বেঁধে ফেলছে গামছা দিয়ে, সঙ্গে হ্যান্ডকাপ।’
সাইফু জানান, তাকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ঘোড়ানো হয়। এর মধ্যে তিনি এক ফাঁকে ‘রওশন গার্ডেন’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট দেখতে পান। সেটি চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন মোড়ের আশপাশে।
ছাত্রদল নেতা জানান, সেই রেস্টুরেন্টের পার্কিং পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে নামানো হয়নি তাকে। গাড়ি থেকে নামায়নি। গাড়িতে ঘোরানোর সময় ওসি কামরুজ্জামান অজ্ঞাত কোনো একজনকে ফোন করে বলেন, ‘আমরা সাইফুলকে কট করছি, ওকে আজকে ফিনিশ করব। তোমরা ইউনিফর্ম পরে হোটেল জামানে যাও।’
সাইফু জানান, ফোনে ওসি সেই রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করার নির্দেশ দেন ‘ওপরের কথা বলে’।
সেটা কে হতে পারেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কাকে বলছে আমি জানি না। আমি শুনছি, কারে বসা অবস্থায়।’
তার ভাষ্য মতে, ফোনে ওসির আলাপন শেষে সাইফুকে নিয়ে যাওয়া হয় লিংক রোডে। তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম যে আকাশ একটি থলে (ব্যাগ) নিয়ে আসছে। আমার ধারণা সেখানে আর্মস জাতীয় কিছু ছিল। কারণ একজন আরেকজনকে বলতেছে ৬ হাজার টাকা দাও ওরে, জিনিস নিয়ে আসছে।’
তিনি জানান, থলে নিয়ে আসার পরই তার কাছে টাকা চাওয়া হয়। তিনি বলেন, “ওটা আনার পর আমাকে অসীম (সোর্স) বলতেছে, ‘সাইফুল, টাকা ৫ লাখ দে’। আমি বললাম, ‘৫ লাখ টাকা দেয়ার হেডাম (সামর্থ্য) আমার নাই’।”
সাইফু জানান, অসীম তার এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের বন্ধু, তাই তাকে তুই করে বলতেন।
তিনি বলেন, ‘টাকা যখন নাই, আমি দিতে পারব না বলছি। আর কিছু বলেনি আমাকে।’
একপর্যায়ে ওসি তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হ্যান্ডকাপ খুলে গামছা দিয়ে হাত বাঁধেন। সে সময় একটা গামছা দিয়ে বাঁধা হয় মুখ, আরেকটা দিয়ে হাত। তারপর তাকে প্রধান সড়ক থেকে রাস্তার অপর পাশে নেয়া হয়।
এরপর তারা ‘ডাকাত, ডাকাত, ডাকাত’ বলে কয়েকটি গুলি করা হয়। তখন রাস্তায় চলাচল করা সব গাড়ি ব্লক করে ফেলা হয়। সাইফুকে কাঁচা রাস্তার মধ্যে উপুড় করে ফেলে রাখা হয়।
তিনি বলেন, ‘ওসি কামরুজ্জামান এসে শটগান দিয়ে আমার পায়ে শ্যুট করছে। গুলি করার এক মিনিট পর এসআই অসীম এসে আবার গুলি করছে।
‘এক্স-রে রিপোর্ট দেখলে বোঝা যাবে ওটা শটগানের গুলি। পিস্তল দিয়ে গুলি করলে একটা বুলেট ঢুকবে। শটগান দিয়ে সচরাচর গুলি করা হয় বিক্ষোভ মিছিলে বা কোনো ঝামেলা হলে।’
তিনি বলেন, ‘আমার পায়ে শটগান দিয়ে করছে যেন পা-টা রাখতে না পারি। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আবিষ্কার করি। পরবর্তী সময়ে সেখানে থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেল। দেরি হওয়ার কারণে আমার পা কেটে ফেলতে হয়েছে।’
গুলিতে পা হারানোর পরও ছয় মামলা
২০২১ সালের ১৭ জুন সাইফুলকে অস্ত্রসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় বলে দাবি করেছিল পুলিশ। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে ১৮টি মামলা থাকার কথা জানায় বাহিনীটি।
এসব মামলার বিষয়ে সাইফু বলেন, ‘ঘটনার সময় পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা ছিল। তবে এর মধ্যে চাঁদাবাজি, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বা কোনো অস্ত্র মামলা ছিল না। এখনও এসব মামলা নাই, তবে অস্ত্র মামলা আছে।’
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে গুলি করার পর পুলিশ মামলা দিছে। এটা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র মামলা নাই। তবে মারামারির মামলা আছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বা ঝগড়াঝাটিতে আমি একটা মারছি, আমাকে একটা মারছে এ রকম। যেহেতু রাজনীতি করি, অনেক মামলা রাজনৈতিক। এখন ২৪টা মামলা, এর ৬টা দিছে গুলি করার পর বিভিন্ন সময়।’
সাইফু বলেন, ‘গুলি করার পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে পা কেটে ফেলার পর ১৬ দিন চিকিৎসা শেষে আমাকে দুটি মামলায় চালান করা হয়। একটি অস্ত্র মামলা, দেশীয় অস্ত্র এলজি, দুটি কার্তুজ দেয়, তিনটি খালি কার্তুজ। আরেকটি হলো পুলিশের ওপর হামলা।’
‘আর সইতে পারি না, আমাকে ক্রসফায়ারে দিন’
একটা পা না থাকা অবস্থায় চলাফেরায় কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরে সাইফু বলেন, ‘ফ্যামিলির লোকজন আমাকে ধরে ধরে হাজিরা দিতে নিয়ে যায়। আবার গাড়িতে করে নিয়ে আসে। আমি যখন ওয়াশরুমে যাই, আমাকে একজনে ধরে নিয়ে যেতে হয়, ধরে বের করতে হয়। এই অবস্থায় আমি যদি জেল খানায় যাই, আমার কী হবে চিন্তা করেন?’
‘কারাগারে পরিবার নাই যে ধরে ধরে গোসল করাবে, ওয়াশরুমে নিয়ে যাবে, থাকা-খাওয়া, কাপড় ধুয়ে দেবে।’
সাইফু বলেন, ‘আমাকে এভাবে মিথ্যা মামলা না দিয়ে হয়রানি না করে প্রশাসন ও সরকারের কাছে দাবি জানাই যে, যদি পারেন আমাকে সঠিক বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, আর না হয় এভাবে মিথ্যা মামলা না দিয়ে, হয়রানি না করে জনসমক্ষে নিয়ে আমাকে ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলুক।
‘আমি রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে থাকলে, রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে থাকলে আমাকে জনসমক্ষে নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী ট্যাগ লাগিয়ে ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলেন, আমার কোনো আফসোস নাই। আমার পিতামাথা সম্মতি জানাবে, আমিও সম্মতি জানাব।’
মামলা করতে এতো দেরি কেন?
এক বছরেরও বেশি সময় আগের ঘটনা হলেও মামলা করতে সোয়া এক বছর লাগল কেন এমন প্রশ্নে সাইফু বলেন, ‘অনেকে প্রশ্ন করতেছে আমি তখন মামলা করিনি কেন। আমাকে গুলি করার পর অস্ত্র পেয়েছে বলে অস্ত্র মামলা দিয়ে চালান করে দেয়। আমি ৯ মাস জেলে ছিলাম। এরপর দুই মাস বাইরে ছিলাম, এরপর আবার আমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ পাঠিয়ে দিল জেলে। আমি সময়ের অভাবে করতে পারিনি।
‘আমি জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর বাসায় যাইনি, বাইরে বাইরে থেকেছি। তখন বায়েজিদ থাানর পুলিশ এসআই রবিউল আমার বাসায় গিয়ে হুমকি দিয়ে আসছে যে, একটা পা ফেলে দিছি, যদি কোনো পদক্ষেপ নেও আরেকটি পাও ফেলে দিব। মানে মামলা করলে পা আরেকটাও ফেলে দিবে বলছে আরকি।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ