গত ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন, সমসাময়িক গণতান্ত্রিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় নির্বাচন হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বিতর্কিত নির্বাচন অতীতেও হয়েছে, ৩০ ডিসেম্বরও হলো। কিন্তু বাংলাদেশ একলা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বা নির্বাচনী পর্যবেক্ষকগণ যেসব মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে কোনো একটি দেশের কোনো একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বা পার্লামেন্ট নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে আখ্যায়িত করে থাকেন, তার বেশির ভাগই আমাদের নির্বাচনে উপস্থিত ছিল।
সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটিকে প্রায় অসম্ভব একটি কাজে পরিণত করেছি। আমাদের নির্বাচনগুলো কেন বিতর্কে ভরা? কেন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আমাদের মাঝে এত তিক্ততা? আমাদের প্রতিবেশী, যারা বেশ কয়েক মাস ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনের আয়োজন করে, তাদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কখনো কোনো ধরনের বিতর্ক দেখা দেয় না বললেই চলে। কোনো রাজনৈতিক দল, এমন কি কংগ্রেসের মতো দল, যারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্য নির্বাচনে প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তারাও নির্বাচন কমিশনের দিকে কখনো অভিযোগের আঙ্গুল তোলে না।
বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাহলে বিষয়টি আমাদের ক্ষেত্রে কেন এত ঝামেলাপূর্ণ? সবার বিশ্বাস, ক্ষমতাসীন দল আমাদের নির্বাচনগুলোতে কারসাজি করে। নির্বাচন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়াটি কি সফল হয়েছিল?
কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে? এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, সে সময়ের সরকার, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলো এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। এ ক্ষেত্রে, ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগের দেওয়া মূল যুক্তি— ‘রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না’ এখন দৈববাণী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি ‘সংক্ষিপ্ত রায়ের’ ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম মুছে দেয়। এমন কী তারা এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ, লিখিত রায়ের জন্যও অপেক্ষা করেনি, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আরও ২ মেয়াদ পর্যন্ত চালু রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। মূলত এরপর থেকেই জনমনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে। এর আগে শুধু পরাজিত দলগুলোই এ ধরনের প্রশ্ন তুলতো।
এবার আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগাম প্রশ্ন উঠছে। প্রসঙ্গত সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। অথচ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ইভিএমে অনাস্থা পোষণ করেছিল। এমনকি ইসির সঙ্গে সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণের দাবি জানানোর পর খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল মন্তব্য করেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী জানি একটা আছে! আমরা অনেককেই আস্থায় আনতে পারছি না। ইভিএম বিষয়ে সংকট থেকে যাবে’ (সময়ের আলো, ৩১ জুলাই, ২০২২)। তাঁর এ মন্তব্যের পর আমরা ভেবেছিলাম, নির্বাচন কমিশন নিশ্চয় অধিকাংশের মত এবং আস্থার সংকটের বিষয়টি আমলে নিয়ে জনস্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। ইসির এ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিস্মিত করেছে।
ইভিএম নিয়ে ইসির সিদ্ধান্তের পর গত ২৮ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুজনের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উপযোগিতা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে ইভিএম সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, আমাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকা। যার ফলে ভোটের ফলাফল পুনর্গণনা বা অডিট করা যায় না। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল দেবে, তা-ই গ্রহণ করতে হবে। আর আমাদের ইভিএমের এ দুর্বলতার কারণেই ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান বুয়েটের সাবেক উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী (প্রয়াত) ইভিএম কেনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ ধরনের দুর্বলতা কাটাতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আমাদের ব্যবহূত ইভিএমের ডিজিটাল অডিট ট্রেইল ব্যবহার করতে হলে অসংখ্য মেশিনের ফরেনসিক অ্যানালাইসিস লাগবে, যার সক্ষমতা আমাদের দেশে নেই।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি হলো, কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যদি ভোটারের উপস্থিতিতে নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএম খুলে দিতে পারেন, তাহলে ভোটারের অনপুস্থিতিতেও ইভিএম খুলে নিজে ভোট দিয়ে দিতে পারেন; যার মাধ্যমে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলেও, সামান্য কয়েক শতাংশ ভোটের ব্যবধানেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। তাই এই ওভাররাইডিংয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন ও তার অধীনস্থ নির্বাচনী কর্মকর্তারা জালিয়াতি করতে পারেন।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি হলো, সব কেন্দ্রের ইন্টিগ্রেটেড ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে বর্তমান ইভিএম সক্ষম নয়। এ কারণেই ইভিএমে ভোট হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল পেতে। আমরা মনে করি, একটি কেন্দ্রের বা একটি পুরো আসনের ভোটদানের ফলাফল যদি ম্যানুয়ালি তৈরি করতে হয়; তাহলে এর অস্বচ্ছতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আমরা নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করতে চাই- কেন এমন ডিজিটাল মেশিন কেনা হলো, যা ম্যানুয়াল ইন্টারভেনশনহীন স্বয়ংক্রিয় ফলাফল তৈরি করতে পারে না?
আরেকটি বিষয় হলো, ভোটের দিন যে ডুপ্লিকেট কার্ড বা প্রি-রেকর্ডেড কার্ড রাখা হবে না- তার নিশ্চয়তা কী? আমরা দেখেছি, সম্প্রতি কুমিল্লা সিটিতে সর্বশেষ ঘোষিত চারটি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে নির্বাচন কমিশন ‘অডিট কার্ড’-এর ফরেনসিক ফলাফল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ঢাকা উত্তরে পরাজিত প্রার্থীর আবেদন সত্ত্বেও ‘কার্ড’-এর ডিজিটাল ফরেনসিক হস্তান্তর করা হয়নি। ভোটের ঠিক আগে ও ভোট শেষ হওয়ার পর ‘অডিট কার্ড’গুলোর ডিজিটাল ফরেনসিকের ব্যবস্থা না থাকাকে আমরা ইভিএমে ভোট গ্রহণের একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া মনে করি।
চতুর্থত, ২০১৮ সালে ভারতের চেয়ে ১১ গুণ দামে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে আরও কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একটি দুর্বল যন্ত্রের জন্য; যা ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতি করা যায় এবং যা নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে, তার জন্য এমন বিরাট পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
সুজনের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যেহেতু ইভিএম ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়; এর সফটওয়্যারের সোর্স কোড অন্য কারও কাছে নেই এবং এটি সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে; তাই এটি দিয়ে বাইরের কারও পক্ষে কারচুপি করা প্রায় অসম্ভব। তবে কমিশনের নিজস্ব প্রাইভেট নেট বা ইন্টারনেটে বসে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে কারসাজি করা সম্ভব। আমরা আরও বলেছি, বর্তমান ইভিএম কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল একটি যন্ত্র। এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নেই। তাই ইভিএমের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কমিশনের এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তা, কারিগরি টিম এবং নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের পক্ষেই যন্ত্রটি দিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করা সম্ভব। তাই আমাদের আশঙ্কা, ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হলে আমরা হয়তো আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচন দেখতে পাব, যার পরিণতিতে জাতি হিসেবে আমরা ভয়াবহ বিপদের দিকে ধাবিত হবো।
মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং এ কারণে কমিশন ইভিএম সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করেছে; যদিও সরকারি দলের মতামত সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেনি। সিইসি ঠিকই বলেছেন- নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব জনগণের পক্ষে ও স্বার্থে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এ কারণেই কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে; সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে এবং কমিশনারদের অপসারণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিচারকদের মতো সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাই ইভিএম ব্যবহার করে প্রশ্নাতীতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে- তা জনগণের সামনে প্রমাণ করার দায়িত্ব ‘বার্ডেন অব প্রুফ’ কমিশনের; অন্য কারও নয়। আমরা কমিশনকে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর এ অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার বিনীত অনুরোধ করছি এবং ইভিএম যে সন্দেহাতীতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযোগী- সে বিষয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
আমরা মনে করি, ইভিএমের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। এমনকি ইভিএমে ভোট চুরি হয়- এমন মন্তব্য করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচনে উভয় প্যানেলই ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেক রাজনৈতিক দলই এটিকে ভোট জালিয়াতির যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। এটি যেহেতু সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে, তাই ইভিএমের ওপর ভোটারদের আস্থা মূলত নির্ভর করে কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। আমাদের ইসির মতোই, কমিশনের আজকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আস্থাহীনতার সমস্যা। তাই ইভিএমের কারিগরি দুর্বলতা, কমিশনের ওপর আস্থাহীনতা এবং আরেকটি পাতানো নির্বাচন এড়ানোর স্বার্থে কমিশনকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- সুষ্ঠু নির্বাচনই একমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ এবং সে পথ রুদ্ধ হলে অশান্তির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল হয়, যা কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। এমনটা ঘটলে জাতি হিসেবে আমরা এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ধাবিত হতে পারি। আর কমিশনের সদস্যদেরও ইতিহাস ক্ষমা করবে না
এসডব্লিউ/এসএস/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ