একটা গল্প বলা যাক, এক রাজার রাজ্যে এক লোক রুটি বিক্রি করতো। সে একমাত্র রুটি বিক্রেতা। সে একদিন রাজার কাছে যেয়ে বললঃ ‘হুজুর, অনেক বৎসর ৫ টাকা করে রুটি বিক্রি করি। এখন দাম বাড়িয়ে ১০ টাকা করতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন!’ রাজা বললেন, ‘যা, কাল থেকে ৩০ টাকা রুটির দাম!’ দোকানী বলল, ‘না হুজুর, আমার ১০ টাকা হলেই চলবে!’ রাজা বললেন, ‘চুপ করে থাক! আর আমি যে দাম বাড়াতে বলেছি, কাউকে বলবিনা!’ রুটি ওয়ালা খুশিমনে ফিরে গেল। পরদিন থেকে তার রুটির দাম ৩০ টাকা! সারা রাজ্যে প্রতিবাদ! জনগণ ক্ষেপে গিয়ে রাজার কাছে বিচার দিল, ‘হুজুর, আমাদের বাঁচান! এ কি অন্যায়! ৫ টাকার রুটি ৩০ টাকা হলে আমরা বাচবো কি খেয়ে!’ রাজা হুংকার দিলেন, ‘রুটি ওয়ালাকে ধরে আনো! এই অন্যায় মানা যায় না!’ তারপর ঘোষণা দিলেন কাল থেকে রুটির দাম অর্ধেক (মানে ১৫ টাকা!) সারা রাজ্যে ধন্য ধন্য পড়ে গেল! শুধু এমন একজন রাজা ছিলো বলে! না হলে জনগণের কি হতো! রুটি ওয়ালা খুশি! জনগণও খুশি! রাজাও খুশি!
উল্লেখ্য, চলতি মাসের গোড়ার দিকে দেশে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চহারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছিল সরকার। এরপর ২৪ দিনের মাথায় গতকাল রাতে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলে দাম লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল রাত থেকেই তা কার্যকর হয়েছে।
দেশে আগস্টের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুদিন ধরে জ্বালানির দাম ধীরে ধীরে কমছিল। জ্বালানি তেলের দাম আট মাসে সর্বনিম্ন হয়েছিল গত সপ্তাহের শুরুর দিকে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বলে আসছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে বাংলাদেশেও কমানো হবে। সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন ছিল জ্বালানি তেলের দাম কত কমাবে সরকার।
দেশে ইতিমধ্যে উচ্চহারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। উচ্চহারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও সমালোচনা করেছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল জ্বালানি তেলের কর প্রত্যাহারের। এ প্রেক্ষিতে গত রোববার রাতে ডিজেলের আগাম কর অব্যাহতি ও আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় সরকার। গত রাতে নির্ধারিত নতুন দাম অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা থেকে কমে ১০৯ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা থেকে ১০৯ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমে ১২৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার।
গত ৫ই আগস্ট দিবাগত রাত ১০টায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ওইদিনই রাত ১২টার পর থেকে নতুন দাম কার্যকর হয়। তখন রেকর্ড পরিমাণে উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি করে ভোক্তা পর্যায়ে লিটার প্রতি ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা বেড়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা দরে বিক্রি শুরু হয়।
২০২১ সালের ৪ঠা নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। তখন এ দুই ধরনের জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। তবে ওই সময় পেট্রোল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। এর ৮ মাস পর গত ৫ই আগস্ট দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়।
এদিকে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, দু-একদিনের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে করের ব্যাপারে আমাদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। সেই সুবিধার কারণে আমরা হয়তো চিন্তা করছি যে, তেলের দাম হয়তো আমরা সমন্বয় করতে পারবো। সেটার হিসাবটা এখনো যাচাই-বাছাই চলছে।
আমরা আশা করছি, এখানে হয়তো একটা পরিবর্তন আসবে। সরকার যেহেতু শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে তেলের মার্কেট আবার বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, তেলের বাজার এখন ১৫০ ডলারের (প্রতি ব্যারেল) উপরে চলে গেছে, যেটা আগে ১৩০ ডলার ছিল। এই অবস্থায় আমরা দাম কতটুকু সমন্বয় করতে পারবো, কারণ এখানে ভর্তুকির বড় একটা অংশ আবার যোগ হবে। যখন ডিজেল ১১৪ টাকা ছিল তখন ডিজেলে ৮ টাকার উপরে ভর্তুকি ছিল, এখন হয়তো সেই জায়গাটা আরও বাড়বে। তারপরও এটা (শুল্ক) কমাতে (তেলের দাম) কতটুকু সমন্বয় হবে- এখনো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। হয়তো আজ-কালকের মধ্যে একটা সিদ্ধান্তে যাবো। এতটুকুই বলতে পারি।
সমন্বয়টা কবে নাগাদ হবে- এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি তো আশা করি কাল-পরশুর মধ্যে কতটুকু যেতে পারি সেটার একটা ব্যবস্থা নেবো আর কি? মাঠ পর্যায়ে সমন্বয়ের সুফল পৌঁছাতে আরেকটু সময় লাগবে। সমন্বয় বলতে কী দাম কমবে, এটা বোঝানো হচ্ছে- এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি তো কখনোই কম-বেশির কথা বলি না। আমি সমন্বয় করতে বলেছি। আমরা চাচ্ছি, ট্যাক্স যে ৫ শতাংশ কমলো, সেটার কতটুকু প্রভাব পড়বে। এটা আমদানির ক্ষেত্রে কমলো কিন্তু খুচরা পর্যায়ে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা তো আমাকে দেখতে হবে।
নসরুল হামিদ আরও বলেন, আমরা তো চাই সমন্বয়টা যাতে বড় আকারে করতে পারি। গিয়ে দেখলাম ওরকমভাবে হলো না, তখনো তো হিসাবের একটা বিষয় আছে। এদিকে তেলের দামও প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে, এটা আমরা আশাই করিনি। আমরা মনে করেছিলাম ট্রেন্ডটা হয়তো নিচের দিকে নামবে। এখন ১৫০ ডলারের ঊর্ধ্বে চলে গেছে, এখনো ভয় পাচ্ছি আরও নাকি বেড়ে যায়। এগুলোর বিষয় আছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গতকাল বিপিসি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শুল্ক কমানোর কারণে তেলের দামের ওপর প্রভাব দেখতে দুই-তিনদিন সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজার থেকে ডিজেল কিনতে ১৩২ ডলার দাম পড়ছে এখন। এখনো লিটারে সাড়ে ৯ থেকে ১০ টাকা লোকসান হচ্ছে বিপিসির। বিপিসির চেয়ারম্যান রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আনার বিষয়ে বলেন, রাশিয়ার তেলের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। নমুনা পরীক্ষা করা হবে। এটি ক্ষুদ্র বিষয়, এ নিয়ে এখনি আমদানির বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এর আগে পেট্রোল পাম্প মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, পেট্রোল পাম্প মালিকদের দাবির বিষয় জ্বালানি বিভাগকে জানানো হবে। তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। আর ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেবে বিপিসি ও মালিকেরা।
তবে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ২৩ দিন পর লিটারে ৫ টাকা কমানোর এই সিদ্ধান্তে জনজীবনে কতটুকু হেরফের হবে তা নিয়ে সংশয়ের কথাই উঠে এসেছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়।
আট মাসের ব্যবধানে দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই তড়তড়িয়ে বেড়েছে গণপরিবহনের ভাড়াসহ সব পণ্য ও সেবার দাম। যে হারে বাড়ানো হয়েছে তার তুলনায় নামমাত্র কমানোর কারণে সেটি আগের বেশি বেড়ে যাওয়া মূল্য কমাতে খুব একটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন না অনেকেই।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কারও কারও সন্দেহ ‘বিন্দুমাত্র’ প্রভাব ফেলবে না এটি। প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেলের দাম লিটারে তিন টাকা কমানো হয়েছিল। ওই সময় দূরপাল্লার যাত্রায় প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা থেকে কমিয়ে এক টাকা ৪২ পয়সা করা হলেও তা পরে কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের ভাড়ায় রদবদল করা হয়নি।
এবার ডিজেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমানোতে পরিবহন মালিকরা জ্বালানি খরচ বাবদ দিনে কয়েকশ’ টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন বলে জানালেও তা ভাড়া কমাতে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সন্দিহান।
এদিকে, ৫ টাকা দাম কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বলেন, জনগণের উপকারের কথা বিবেচনা করে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমনটা করা হয়েছে।
“এত বেশি বাড়িয়ে মাত্র পাঁচ টাকা কমিয়ে আনার অর্থ হচ্ছে বাড়ানোটাকে টেকসই করা; বিতর্কমুক্ত করা। বলা যেতে পারে এটা হাস্যকর প্রয়াস।“
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, “জনগণের দিকে তাকিয়ে এটা কমানো হয়নি; তাহলে মানুষের উপকার হবে কী করে। তখন তো ১/২ টাকা ফকিরকে ভিক্ষা দেওয়া যেত, এখন তো ৫ টাকা ফকিরের ভিক্ষাও নেই।
“এরকম ফকিরের ভিক্ষার মত ৫ টাকা কমিয়ে জনজীবনে কী প্রতিকার হবে? এটা নিয়ে কথা বলাও নিজের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ