বগুড়ায় মাত্র আড়াই কিলোমিটারের একটি সংযোগ সড়ক ১৮ বছরেও শেষ করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। বিপরীতে এ সময় দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো হয়। ফলে সড়কটির নির্মাণব্যয় প্রায় ১৪ গুণ বেড়েছে। বর্তমান হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। দুর্ভাগ্যজনক হলো, সময়ের পরিক্রমায় ব্যয়বহুল সড়কটি এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
বগুড়া শহরের যানজট কমাতে ২০০৪ সালে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি পাস হয়। শুরুতে সড়কটির দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল সাড়ে ৪ কিলোমিটার, ব্যয় ধরা হয়েছিল পৌনে ১৪ কোটি টাকা। তখন মূল সড়কের সঙ্গে দুটি আন্তঃসড়ক লিংক করা হয়েছিল। পরে খরচ কমাতে সড়কের দৈর্ঘ্যের পাশাপাশি সংযোগ সড়ক বাদ দেওয়া হয়।
ওই বছর পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শেষ হয়। ১ দশমিক ১২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণও করা হয়। পরে রাস্তার দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ ৩ বছর ধরা হলেও পরবর্তী ১২ বছরে কাজ হয় মাত্র ৮০০ মিটার। সওজ সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের পর এই সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে যায় নানা জটিলতায়।
পরিকল্পনা কমিশন এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত অসমাপ্ত ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে ২০১৭ সালে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। ওই সময় সড়কটি নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১০৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
পরে প্রকল্প সংশোধন ছাড়াই তিন দফায় সড়কটি নির্মাণের সময় বাড়ানো হয়। প্রথমবার ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ২০২১ সালের জুন এবং তৃতীয়বার ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়। গত অর্থবছরেও কাজ শেষ না করতে পারায় নতুন করে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব রেখে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
গত বছর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে এই প্রকল্পে ৭৫.৯২ শতাংশ বা ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। অথচ ২০০৪ সালে নির্মাণ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তখন সাড়ে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থ সড়ক নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, মাটি কাটা এবং কার্পেটিংয়ের ব্যয় মিলিয়েই এ খরচ ধরা হয়।
একটি জেলা শহরের সংযোগ সড়কের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ করতে প্রায় ৭৪ কোটি টাকা খরচ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে বগুড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বলছে, ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ ভূমি অধিগ্রহণে খরচ বেড়ে যাওয়া। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জমির দাম বাবদ প্রচলিত দামের তিনগুণ অর্থ দেওয়া হচ্ছে।
এই উচ্চ ব্যয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অতিরিক্ত খরচ এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ছোট-বড় অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ-আড়াই গুণ সময় লাগছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এর মূল কারণ প্রকল্প টিমের জবাবদিহির অভাব।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব (সদস্য) মামুন-আল-রশীদ বলেন, নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইনে জমির ক্ষতিপূরণ বেড়েছে। ফলে সংশোধিত প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কেন কাজ শেষ হচ্ছে না, তদন্ত করে দেখা দরকার।
বগুড়া-৬ (সদর) আসনের বিএনপি দলীয় সাংসদ গোলাম মো. সিরাজ বলেন, ১৮ বছর ধরে প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের শতকোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। এভাবে প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখলে প্রকল্প ব্যয় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। আমি এটিকে সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই বলব না।
শুরুতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়, এ সড়ক নির্মাণ হলে যানজট কমে বছরে পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। এখন ১০ বছর পর এসে যানবাহন বেড়ে গেছে ২০ গুণ। মূল সড়কে প্রচণ্ড চাপে যানবাহনের গতি হচ্ছে শ্নথ। এ কারণে একটি মাত্র সড়কে আয়-ব্যয় বিশ্নেষণে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক বলে মনে করা হচ্ছে।
সড়কটির পরিকল্পনা করার সময় শহরে যানজট ছিল কম। ব্যক্তিগত গাড়িও কম ছিল। ফলে শহরের স্টেশন রোড হয়ে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের পাশে দিয়ে ব্যাংকপাড়া, ঠনঠনিয়া, সিঅ্যান্ডবি গোডাউন, মালগ্রাম, সিলিমপুর এলাকা দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে সড়ক বিভাগ। এ সড়কটির দুটি সংযোগ পয়েন্ট করার কথা ছিল কারবালা মুরগির ফার্ম হয়ে ওয়াপদা রোড এবং টিনপট্টি এলাকা হয়ে। শহরের উত্তর প্রান্তের লোকজনের হাসপাতালে যাতায়াতের স্বার্থে এ সড়কটি ব্যবহারের কথা ছিল।
কাজের বর্তমান অবস্থা
দ্বিতীয় অংশের ১.৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১.২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ করছে আমিরুল হক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আমিনুল হক বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। জমির দাম বাড়ায় একনেকের অনুমোদনের জটিলতায় কাজ দেরি হয়েছে। আমরা জমি বুঝে না পেলে কাজ শুরু করতে পারি না। একটি কাজ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে সেটির খরচ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ২.৫৮ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান। সড়ক বাঁধে মাটির কাজ, ১৩ মিটার আরসিসি কালভার্ট নির্মাণ ও ৩ হাজার মিটার ড্রেন নির্মাণ। ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার নতুন পেভমেন্ট নির্মাণসহ সাইন সিগনাল ও গার্ডপোস্ট।
বর্তমানে বগুড়া পাসপোর্ট অফিসের পশ্চিম প্রান্তের ব্রিজের সামনে থেকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল পর্যন্ত এলাকায় কোনো কাজই শুরু হয়নি। এ এলাকায় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি রয়েছে। রয়েছে পৌরসভার একাধিক রাস্তা, গ্যাস ও পানির পাইপলাইন, বৈদ্যুতিক খুঁটি। এসব সমাধান না করে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মোস্ত শেখ বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কাজ থেমে আছে। অধিগ্রহণও থেমে আছে। এই সড়কটি সঠিক সময়ে তৈরি করা গেলে কাজে আসত। এখন যানবাহন যেভাবে বেড়েছে, তাতে এই সড়কটি খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
সওজ কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বগুড়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান জানান, ভূমি অধিগ্রহণে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজনে প্রকল্প সংশোধন করতে গিয়ে একনেকের অনুমোদন নিতে তিন বছর লেগে যায়। তবে বর্ধিত সময়ের মধ্যেও এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি জানান, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। তবে একনেকে ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা উল্লেখ আছে।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আসাদুজ্জামান বলেন, ৬৫০ মিটার রাস্তার কাজ বাকি আছে। এ অংশের উচ্ছেদ বা অধিগ্রহণের কাজও বাকি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জমির ক্ষতিপূরণের টাকা শিগগিরই পরিশোধ করার মাধ্যমে সড়কের কাজ শুরু করতে পারব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ