যুক্তরাষ্ট্রের এক চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং আফগানিস্তানের এক প্রযোজককে আটকে রেখেছে তালিবান সরকার। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে তাদের অবিলম্বে মুক্তি চেয়েছে সংবাদমাধ্যম পর্যবেক্ষক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে)। সাংবাদিকদের ওপর ধরপাকড় না চালানোরও আহ্বান জানানো হয়েছে। সংস্থাটির বরাতে রোববার(২১ আগস্ট) এ তথ্য জানিয়েছে এনডিটিভি ও এএনআই।
গত ১৭ আগস্ট কাবুলের শেরপুরে পেশাগত কাজ করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও নির্মাতা আইভর শিয়ারার এবং প্রযোজক ফয়জুল্লাহ ফয়জবখশকে আটক করে তালিবান।
নিরাপত্তারক্ষীরা আইভর ও ফয়জুল্লাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট পরীক্ষা করে। দীর্ঘ সময় আটকে রেখে তাদের বারবার যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হয়।
সিপিজের বিবৃতিতে বলা হয়, হুমকি-ধমকি না দিয়ে ওই দুজনকে মুক্তি দিতে হবে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক মাসের ভিসা নিয়ে আফগানিস্তানে যান নির্মাতা আইভর। পরে এক বছরের জন্য বাড়ানো হয় তার ভিসার মেয়াদ।
তালিবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আফগানিস্তানের গত ৪০ বছরের ইতিহাস নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাচ্ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ফেস্টিভ্যালে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ও ভিডিওর প্রদর্শনী হয়েছে।
আইভরের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন প্রযোজক ফয়জুল্লাহ।
সিপিজের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ আগস্ট কাবুলে ডিস্ট্রিক্ট ১০–এর শেরপুর এলাকায় চলচ্চিত্রের শুটিং করছিলেন শিয়ার ও ফাইজবখশ। আগস্টের শুরুর দিকে এ এলাকাতেই মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন আল–কায়েদা নেতা আল জাওয়াহিরি। শিয়ার ও ফাইজবখশ কাজ করার সময় বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের বাধা দেন।
কংগ্রেসের অর্থায়নে পরিচালিত সম্প্রচারমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার দারি ভাষার সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তালিবানের প্রতিশোধমূলক আচরণ নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানাশোনা থাকা দুজন সাংবাদিকও এ নিয়ে সিপিজের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তবে নিজেদের নাম প্রকাশ না করতে সিপিজেকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
ওই দুই সাংবাদিক বলেন, প্রহরীরা তাদের (শিয়ার ও ফাইজবখশ) কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন, তাদের কাজের অনুমতি আছে কি না, পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট আছে কি না, তা যাচাই করেছেন। এরপর সাংবাদিকদের মুঠোফোনগুলো জব্দ করা হয়, তাদের কয়েক ঘণ্টা আটক রাখা হয়। বারবারই তাদের আমেরিকান গুপ্তচর বলে ডাকা হচ্ছিল। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এরপর তালিবান গোয়েন্দাদের ডেকে আনেন। প্রায় ৫০ জন সশস্ত্র গোয়েন্দা কর্মী সেখানে পৌঁছান। এরপর শিয়ার ও ফাইজবখশের চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
গত ১৭ আগস্ট কাবুলে ডিস্ট্রিক্ট ১০–এর শেরপুর এলাকায় চলচ্চিত্রের শুটিং করছিলেন শিয়ার ও ফাইজবখশ। আগস্টের শুরুর দিকে এ এলাকাতেই মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন আল–কায়েদা নেতা আল জাওয়াহিরি। শিয়ার ও ফাইজবখশ কাজ করার সময় বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের বাধা দেন।
সিপিজের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কার্লোস মার্টিনেজ দে লা সেরনা বলেন, ‘তালিবানের চাপ বেড়েছে। আমেরিকান চলচ্চিত্রনির্মাতা আইভর শিয়ার ও তার আফগান সহকর্মী ফাইজুল্লাহ ফাইজবখশকে আটকসহ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ধরপাকড়ের সংখ্যা বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, আফগানিস্তানে মুক্ত গণমাধ্যম নীতির ব্যাপারে সংগঠনটির অঙ্গীকারে প্রচণ্ড রকমের ঘাটতি রয়ে গেছে। তালিবান কর্মকর্তাদের অবশ্যই অবিলম্বে শিয়ার ও ফাইজবখশকে মুক্তি দিতে হবে এবং আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ ও ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।’
দুই সাংবাদিক সিপিজেকে বলেন, তালিবানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কাজের অনুমতি পাওয়ার পর এক মাসের ভিসা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তানে পৌঁছান শিয়ার। আফগানিস্তানের গত ৪০ বছরের ইতিহাস নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে আফগানিস্তান যান তিনি।
শিয়ারের চলচ্চিত্র ও ভিডিও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের জাদুঘর ও চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। আর প্রযোজক ফাইজবখশ আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাংবাদিকদের কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। শিয়ারের সঙ্গেও তার চুক্তি হয়েছিল।
গত ৩ মার্চ শিয়ারকে এক বছরের কাজের অনুমতি দেয় তালিবানের শ্রম ও সামাজিক কর্মকাণ্ডবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আফগানিস্তানে থাকার জন্য তার ভিসার মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে শিয়ারকে তালিবানের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। ওই দুই সাংবাদিকের একজন সিপিজেকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এবং পূর্ববর্তী কাজগুলো উপস্থাপন করতে বলেছেন।
ওই সূত্রের ভাষ্য, শিয়ারকে বলা হয়েছে তার কাবুলে উপস্থিতি নিয়ে তালিবান গোয়েন্দারা সন্দেহ করার কারণে তাকে তলব করা হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েকজন তালিবান গোয়েন্দা কাবুলে একটি অতিথিশালা পরিদর্শন করেন। ওই অতিথিশালায় থাকতেন শিয়ার। তাকে তার কাজ ও অবস্থানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
১৬ আগস্ট শিয়ারের বিরুদ্ধে আবারও সমন জারি করেন বালখি। শিয়ার ওই সূত্রকে বলেছিলেন, তিনি একের পর এক সমন জারি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সেপ্টেম্বরের পর তাকে আফগানিস্তানে থাকতে দেওয়া হবে নাকি সেখান থেকে বহিষ্কার করা হবে, তা তিনি জানেন না।
১৬ আগস্টের ওই সমন নিয়ে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করতে পারেনি সিপিজে।
আফগানিস্তান তালিবানের দখলে যাওয়ার পর আফগানদের ওপর তালিবান কী কী করতে পারে তার একটি অনুমান পূর্ব থেকেই ছিল। তালিবান বাহিনী মুখে উদারনীতির কথা যতই বলুক না কেন, তারা তাদের নতুন শাসনেও আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগানিস্তানে দৃশ্যত: কোনো স্বাধীন গণমাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। এ সময় টেলিভিশন, সংগীত এবং সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গুলো প্রকাশিত হতো, কিন্তু এগুলোতে মানুষের কোন ছবি ছাপানো হতো না।
কুড়ি বছর আগে তালিবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন বাহিনী কাবুলের দখল নিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। এই সময়ে চালু হয় বেসরকারি টেলিভিশন, একাধিক সংবাদ ভিত্তিক চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হয়; এফ এম রেডিও চালু হয়, বিশ্বিবিদ্যালয়গুলো সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করে, মোবাইল ফোন যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করে, উন্মুক্ত হয় ডিজিটাল প্রযুক্তি।
ওই বিশ বছরে ১৭০টিরও বেশি এফএম রেডিও অনুমোদন পায়, কাবুল থেকেই প্রকাশিত হয় ৯টি সংবাদপত্র, ৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং ৫টি বার্তা সংস্থায় কাজ করেন কয়েক হাজার সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী। দেশটিতে প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ২২ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে।
কিন্তু গত ১৫ আগস্ট তালিবানের হাতে আফগান সরকারের পতনের পর পরিস্থিতির বদল হলো দ্রুত। তালিবানের আশ্বাস সত্ত্বেও আফগানিস্তানে স্বাধীন গণমাধ্যম সম্ভব হবে না বলে জানায় সাংবাদিকরা। কারণ আগেকার যে তালিবান সরকার গণমাধ্যমকে বিকশিত হতে দেয়নি, এখনকার নেতৃত্বে তারাই অধিষ্ঠিত; আর সাংবাদিকদের কথাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৬
আপনার মতামত জানানঃ