তর্কাতীতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন সভ্যতাগুলোর একটি গড়ে উঠেছিল মিশরের নীল নদের অববাহিকায়। নীল নদের উর্বর ভূমিতে কৃষিকাজের মধ্যদিয়ে যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল সেটির ধারক ও বাহক সেখানকার সূউচ্চ পিরামিডগুলো। বিশাল এই স্থাপনাগুলোর ভেতরে থাকা সংরক্ষিত মরদেহ বা মমি নিয়ে আজও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই সভ্যতাকে কেউ কেউ আবার বলেন ভালোবাসার সভ্যতা। কিন্তু ইতিহাসবিদদের ভাষায় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সভ্যতা ছিল এটি।
তুতেনখামেন, থুতমোস এবং রামসিসের মতো সম্রাটদের বুদ্ধিমত্তায় গড়ে ওঠা এই সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল আজকের সুদান ও সিরিয়া পর্যন্ত। আধুনিক যুগের প্রকৌশলীদের অবাক করা সব স্থাপনা রয়েছে মিশরের নীল নদের অববাহিকায়।
কথিত রয়েছে, ২৬০০ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে একেকেটি পিরামিড তৈরিতে ১ লাখ পুরুষ শ্রমিকের প্রয়োজন পড়তো। বলতে গেলে সেকালের পৃৃথিবীর প্রযুক্তিগত তীর্থস্থান ছিল ফারাও শাসিত মিশর! কৃষি, গণিত, বিজ্ঞানসহ বেশকিছু দিকদিয়ে বেশ উন্নতি করা মিশরীয় সভ্যতার পতনের সূচনা শুরু হয় ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মিশর জয়ের মধ্যদিয়ে।
পৃথিবীর শক্তিশালী এই সভ্যতার পতনের জন্য শুধু রোমানদের কৃতিত্ব দিলেই কি ইতিহাস লেখা হয়ে যায়? কখনোই না। বরঞ্চ নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে সুবিধাবাদী বিদেশী শক্তির মদদে পতন ঘটে তাদের।
বলা হয়ে থাকে, তৃতীয় রামসিসকে হত্যার মধ্যদিয়ে মিশরীয় সভ্যতার পতন শুরু হয়। সত্যিই কি তাই? এই হত্যাকাণ্ড ছাড়াও আর কী কী কারণ রয়েছে মিশরীয় সভ্যতার পতনের পেছনে সে সম্পর্কে আজ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
প্রথম কারণ
৩১ বছর যাবত মিশর শাসন করা তৃতীয় রামসিস ছিলেন প্রথমদিকের ফারাওদের শেষ শাসক। তার শাসনামল থেকেই দুর্বিষহতার মধ্যে দিনযাপন করেছিল লোকেরা। জলদস্যুদের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রায়শই মিশরীয়দের ক্ষয়ক্ষতি হতো তখন। তবে এসব জলদস্যুদের পরিচয় সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত একটি গোষ্ঠী বসবাসের জন্য নতুন জমির খোঁজে সেখানে পৌঁছায়। শুধু রামসিসের শাসনামলে কমপক্ষে দুইবার অজ্ঞাত নৌবহরের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয় মিশর।
খ্রিস্টপূর্ব ১১৭৭ সালে রামসিসের নেতৃত্বে মিশরীয় নৌবাহিনী, জলদস্যুদের দ্বিতীয়বারের আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেন। ওই বিজয় উদযাপনে ফারাও মেডিনেটে অবস্থিত মন্দির ও সমাধিতে বিজয় পতাকা স্থাপন করেন তিনি। যদিও রামসিসের এই উদযাপন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রাসাদে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়।
ব্রোঞ্জ যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক এরিক ক্লাইন লিখেছেন, রামসিসের হেরেমের একজন ঈর্ষান্বিত রানি কিংবা সঙ্গিনি কর্তৃক তিনি খুন হয়েছিলেন। মিশরের পিরামিড থেকে পাওয়া তার মমি সিটিস্ক্যান করে জানা যায়, রামসিসকে ১১৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গলায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছিল। তার হত্যাকাণ্ডকেই মিশরীয় সভ্যতার পতনের শুরু বলে আখ্যা দেন ইতিহাসবিদরা।
দ্বিতীয় কারণ
খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। একেতো খরায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল, তার উপর আবার জলদস্যুদের আক্রমণে অনেকগুলো অঞ্চল পতনের মুখোমুখি হয়। গ্রিসের মাইসেনিয়ট, তুরস্কের আনাতোলিয়ায় বসবাসকারী হিট্টাইটরা চোখের সামনে নিজেদের শহর, সংস্কৃতি এবং ভাষাসমূহ নিশ্চিহ্ন হতে দেখেন।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন তৃতীয় রামসিস যখন জলদস্যুদের প্রতিহত করতে পেরেছিলেন তাতে মিশর দীর্ঘকাল সুরক্ষিত ছিল ঠিকই তবে পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর পতন ঘটে। এতে করে প্রায় দেড়শত বছর মিশরীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
ব্রোঞ্জ যুগের শেষদিকে দস্যুদের দাপট যতো বাড়তে থাকে ওই অঞ্চলের বাণিজ্যিক রুটগুলো ততোই বন্ধ হতে শুরু করে। একে একে প্রায় প্রতিটি দেশ ও সাম্রাজ্য ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পতিত হয়। এই সংকটের সঙ্গে বার বার শত্রুর আক্রমণ তো রয়েছেই। এক পর্যায়ে মিশর নিজের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতা হারানোর কারণে ওই অঞ্চলে কর্তৃত্ব হারায়।
ফলে মিশর ক্রমেই সে সময়ের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে সরে যায়। এটিকেও ওই সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন ইতিহাসবিদরা। মিশর নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারলে হয়তোবা আরও কয়েকশত বছর টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু নীল নদ তো আর আজীবন তাদের রক্ষা করে যাবে না!
তৃতীয় কারণ
তৃতীয় রামসিসের মৃত্যুর পর তার যে উত্তরসূরিরা মিশর শাসন করেছেন সবাই ছিলে অকার্যকর। অন্ততপক্ষে একাদশ রামসিসের শাসনামল পর্যালোচনা করলে মিশরের দ্রুত পতনের কারণগুলো জানা যায়। তিনি ১০৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান। এদিকে গুঞ্জন রয়েছে পঞ্চম রামসিস গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
ইতিহাসবিদরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তিনি সত্যিই গুটিবসন্তে আক্রান্ত ছিলেন কিনা। তবে পঞ্চম রামসিস এবং তার পরিবারের সদস্যদের যে নতুন সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেটা নিশ্চিত। আর ওই সমাধির আশেপাশে ৬ মাস অন্যদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল বলেও জানান ইতিহাসবিদরা। এই প্রমাণাদি থেকে গবেষকরা মনে করেন, ওই সময়ে মিশরে গুটিবসন্তের বড়সড় মহামারি সংঘটিত হয়েছিল।
শুধু রোগবালাই নয়, নিজেদের সম্পদ নিজেরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হন ফারাও সম্রাটরা। পঞ্চম ও ষষ্ঠ রামসিসের শাসনামলে মিশর সিনাই উপদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ তামা ও হীরার খনির নিয়ন্ত্রণ হারায়। খনিতে থাকা খোদাইকৃত শেষ নামগুলো এই দুজনের ছিল বলেই ধারণা করছেন গবেষকরা। আনুমানিক ১১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিনাই ও কেনান অঞ্চল থেকে মিশর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর নবম রামসিসের শাসনামলে আরও খারাপ সময় পার করতে থাকে মিশর।
লোকেরা অর্থনৈতিকভাবে এতোটাই খারাপ অবস্থা পার করছিল যে, তারা বাধ্য হয়ে পিরামিড ও সমাধিতে হামলা চালিয়ে সোনা, রূপাসহ অনেক ধনসম্পদ লুট করা শুরু করে। সাম্রাজ্যের নিয়ম অনুসারে এটি বড়সড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও লোকেরা নবম রামসিসের তোয়াক্কা করতো না। ফলে বাধ্য হয়ে পূর্ববর্তী শাসকদের অনেক মমি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হন তিনি।
চতুর্থ কারণ
নতুন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর মিশর বরাবরই বিদেশি শক্তি দ্বারা শাসিত হয়। এতে করে সাম্রাজ্যটি নিজের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে। মিশরের পশ্চিমাঞ্চলে যাযাবর হিসেবে বসবাস শুরু করা লিবিয়ানরা ধীরে ধীর সিংহাসন অবধি পৌঁছাতে পেরেছিল। লিবিয়ান বংশোদ্ভূত ফারাও প্রথম শোশেঙ্ক ছিলেন সাম্রাজ্যের ২২তম রাজবংশের প্রথম ফারাও। খ্রিস্টপূর্ব ১০ শতকে ইসরাইল, জুডোসহ কয়েকটি অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তিনি তৃতীয় রামসিসের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নুবিয়ানরা রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও মিশরের সিংহাসন দাবি করে। ফারাওদের ২৫তম উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রায় একশত বছর যাবত মিশর শাসন করেছিল তারা। বলা হয়ে থাকে এই নুবিয়ানদের নিকট ক্ষমতা যাওয়ার মধ্যদিয়ে স্বাধীন সাম্রাজ্য হিসেবে মিশরের সমস্ত সম্মানের পতন ঘটে।
তাদের বিতাড়িত করে অ্যাসিরিয়ানরা মিশরের সিংহাসন দখল করে নেয়। এরপর ক্রমান্বয়ে পারস্য, গ্রিক, রোমান এবং শেষমেশ মুসলমানরা মিশর দখল করে। তবুও মিশর তখন আর মিশর নেই। এটি ততদিনে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মুমূর্ষু এক অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতো। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমাইক রাজবংশ মিশর শাসন শুরু করে।
সপ্তম ক্লিওপেট্রা হলেন টলেমাইক ফারাওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতে রাজধানী স্থাপন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে রোমান সম্রাট আগাস্টাস যখন ক্লিওপেট্রাকে পরাজিত করেন তখন মিশর রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। আর এই পতনের মধ্যদিয়েই মিশরীয় সভ্যতা তথা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫৮
আপনার মতামত জানানঃ