বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ১৩টি জেলা ম্যালেরিয়া প্রবণ। এর মধ্যে পার্বত্য তিন জেলা সবচেয়ে বেশি। রাঙামাটির উপজেলাগুলোর মধ্যে জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বরকল ও বিলাইছড়ি অন্যতম ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা। দীর্ঘ বর্ষা, মশারির কার্যকারিতা কমে যাওয়া এগুলোকেই বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা।
পাহাড়ে গত দুই মাস ধরে দ্রুত গতিতে বাড়ছে ম্যালেরিয়া রোগের আক্রান্তের সংখ্যা। জেলা সদরের চেয়ে এ রোগের প্রকোপ উপজেলায় দুর্গম এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি। গত দুই মাসে পাহাড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ম্যালেরিয়া। এতে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ে গত দুই মাস ধরে দ্রুত বাড়ছে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। জেলা সদরের চেয়ে এ রোগের প্রকোপ উপজেলায় দুর্গম এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি। যা গত দুই মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে।
জেলার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, এ বছর জুন মাসে জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪০৪ জন হলেও জুলাই মাসে তা বেড়ে ৭২৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে জুরাছড়িতে সবচেয়ে বেশি রোগী। জুরাছড়িতে ২৬৩, বরকল ৮৫, বাঘাইছড়ি ১৩২, নানিয়াচর ২, লংগদু ১৪, কাউখালী ২, কাপ্তাই ২, রাজস্থলী ৬১, বিলাইছড়ি ১৫৮ ও রাঙামাটি সদরে ৫ জন রোগী পাওয়া গেছে।
রাঙামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, জুরাছড়ির দুমদুম্যা, মৈদং, বিলাইছড়ি ও বরকলে এবার হানা দিয়েছে ম্যালেরিয়া। দুর্গম ও সীমান্তবর্তী হওয়ায় সরকারি চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা ও সচেতনতার অভাবে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। জুরাছড়িতে গত দু’মাসে বিভিন্ন স্থানের লোকজন জ্বর, কাঁশিসহ শারীরিক দুর্বলতার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে চিকিৎসা নিতে এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে তাদের শরীরে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু পাওয়া যায়।
জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে জুলাই মাসে ২৬৩ জনের দেহে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। জুন মাসে পাওয়া যায় ১২৩ জনের দেহে। এছাড়া বাঘাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে গত বছর জুনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৯ জন, জুলাই মাসে ৪৭ জন যা এ বছর জুনে ১৩২ জন, জুলাই মাসে ১৩৬ জন রোগীর সন্ধান মিলেছে।
দেশে গত বছর যতসংখ্যক ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই হয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে বান্দরবানে। তারপর রয়েছে যথাক্রমে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি।
গত বছর দেশে মোট ৭ হাজার ২০১ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়।
গত বছর বান্দরবান জেলায় শনাক্ত হয় ৫ হাজার ১২৮ জন ম্যালেরিয়া রোগী। রাঙামাটিতে ১ হাজার ৫৬৯ জন। খাগড়াছড়িতে ১০৪ জন। কক্সবাজারে ৩৫১ জন। চট্টগ্রাম জেলায় ৪৯ জন।
চট্টগ্রামে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬ জন মারা যায়। তারা পাহাড়ি এলাকা থেকে এই রোগ বহন করে জেলায় এসেছিল বলে জানান চিকিৎসকেরা। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন মারা যায় বান্দরবানে, একজন কক্সবাজারে।
২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। তবে দেশে এখনো হাজারো ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বিশ্বে প্রতিবছর মশাবাহিত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লাখো মানুষ মারা যায়। ২০২০ সালে ৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যায়।
দেশে পাহাড়ের দুর্গমতার কারণে সেখানে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি সঠিক গতি পাচ্ছে না। এ ছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। জ্বর হলেও তারা সহজে হাসপাতালে যায় না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে পাহাড়ের দুর্গমতার কারণে সেখানে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি সঠিক গতি পাচ্ছে না। এ ছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। জ্বর হলেও তারা সহজে হাসপাতালে যায় না।
গত বছর মোট শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ১৬০ জন জটিল বা সেরিব্র্যাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। বাকিরা অন্যান্য ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, গত বছর যারা মারা গেছেন, তাদের বেশির ভাগ জটিল বা সেরিব্র্যাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
গত বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে বেশি ছিল। ২০২০ সালে শনাক্ত রোগী ছিল ৬ হাজার ১০৪ জন। মারা যায় ৭ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিল চট্টগ্রাম জেলার। বান্দরবানের ২ জন।
গত বছরের মতো ২০২০ সালেও বান্দরবানে ম্যালেরিয়া রোগী ছিল সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা ৪ হাজার ১৭৭ জন।
জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অনন্যা চাকমা বলেন, জুন-জুলাই মাসে দুর্গম পাহাড়ে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাহাড়ে কম-বেশি থাকে।
তিনি বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও রোগটি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে দক্ষ সহকারী সার্জন ও স্বাস্থ্য কর্মীরা চিকিৎসা সেবা নিবেদিতভাবে দিয়ে যাচ্ছেন।
রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বলেন, ‘গত দুই বছরের তুলনায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অনেক বেড়েছে। পাহাড়ে জুন থেকে আগস্ট পার্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। তবে গত বছর যেখানে রোগী এক হাজার ৬০০ ছিল, সেখানে এবার জুন ও জুলাইতেই প্রায় দ্বিগুণ রোগী হয়ে গেছে। তবে মশারির ব্যবহার বাড়ানো এবং জ্বর দেখা দিলে রক্ত পরীক্ষার জন্য পাহাড়িদের উৎসাহিত করতে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
ম্যালেরিয়া পৃথিবীজুড়ে এখনো একটি ঘাতকরোগ হিসেবে পরিচিত৷ প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ লোক এ রোগে প্রাণ হারায়৷ আর ৮৫ ভাগ মৃত ব্যক্তিই হলো পাঁচ বছরের নিচের শিশু৷ এ রোগ যদিও আফ্রিকা মহাদেশের প্রধান রোগ, তবু এখনো এশিয়া ও ল্যাতিন আমেরিকার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ম্যালেরিয়া৷
প্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে, পাহাড়ি এলাকায় জুমচাষের এই মৌসুমে গ্রামগুলোতে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ায় শত শত পরিবার সংকটে পড়েছে৷ মৌজা কিংবা গ্রামভিত্তিক বিশেষ মেডিকেল টিম পাঠানোর মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের আহবান জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ