পারমাণবিক বোমার সাথে আমরা বহুল পরিচিত৷ ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ সময়ে আমেরিকা যখন জাপানে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দুটো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, তখন পৃথিবীবাসী এক নতুন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সাথে পরিচিত হয়েছিল। সেই বোমার ধ্বংসলীলা দেখে সাধারণ মানুষেরা আতঙ্কিত হলেও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের চোখ লকলক করে উঠেছিল।
ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, আমেরিকার পর আরও সাতটি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে সে রাষ্ট্রগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বোমার সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ধারণা করা হয়, ইসরায়েলেও পারমাণবিক বোমা রয়েছে, যদিও রাষ্ট্রটি বারবার সে কথা অস্বীকার করেছে।
আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তো বটেই, সাধারণ রাষ্ট্রগুলোও বর্তমানে পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। আপনার দেশে যদি পারমাণবিক বোমা থাকে, তাহলে যেকোন দেশই আপনার উপর হামলা চালানোর আগে দু’বার ভাববে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আপনার দরকষাকষির ক্ষমতা বেড়ে যাবে।
এর মধ্যেই পৃথিবীতে দক্ষিণ আফ্রিকা হচ্ছে এমন একটি দেশ, যারা নিজেরা গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার পরেও পরবর্তীতে আবার সেই বোমার সম্ভার স্বেচ্ছায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ‘প্রথম দেশ’ নয়, যারা এই কাজ করেছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘স্যাটেলাইট স্টেট’ বেলারুশ, কাজাখস্তান এবং ইউক্রেনের কাছেও পারমাণবিক বোমা ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তারা সেগুলো রাশিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে বাকি তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে নিজেদের গবেষণা ও অর্থায়নে বোমা তৈরি করেছিল এবং এগুলো সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও লোকবলও তাদের কাছে ছিল, সেখানে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর (ইউক্রেন, বেলারুশ এবং কাজাখস্তান) সেসব ছিল না। অর্থাৎ, এই রাষ্ট্রগুলো যেখানে একপ্রকার বাধ্য হয়ে পারমাণবিক বোমাগুলো ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য থাকার পরও পারমাণবিক বোমার সম্ভার ধ্বংস করেছিল। এই ধ্বংস কিংবা ‘পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ’-এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকলেও বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে এটি ছিল বিরাট এক পদক্ষেপ।
কেন দক্ষিণ আফ্রিকা পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার জন্য তোরজোড় শুরু করেছিল, তার প্রেক্ষাপট জেনে নেয়া যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার এই পারমাণবিক বোমার উচ্চাভিলাষের পেছনে স্নায়ুযুদ্ধের বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পুরো পৃথিবীই বলতে গেলে দুটো ব্লকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এক ব্লকে ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো, যাদের অভিভাবক ছিল আমেরিকা। আরেক ব্লকের রাষ্ট্রগুলো কমিউনিজমের নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল, যাদের অভিভাবক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই ব্লকের রাষ্ট্রগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা আমেরিকার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়ে আসছিল। যেমন বলা যায়, আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর পুনর্গঠনের জন্য ‘মার্শাল প্ল্যান’ নিয়ে হাজির হয়েছিল। এই পরিকল্পনার অধীনে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেয়া হয়। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলোকে ‘মলোটোভ প্ল্যান’ এর অধীনে মোটামুটি বড় অংকের সহায়তা প্রদান করেছিল। আমেরিকা সহায়তা দিয়েছিল এই কারণে, যাতে করে এই দেশগুলোর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সুযোগ না নিয়ে কমিউনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করেছিল যাতে করে বিপ্লব ছড়িয়ে যায়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের আধিপত্যবাদী নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা চেয়েছিল আফ্রিকায় যে স্বাধীনতাকামী আন্দোলনগুলো চলমান ছিল, সেগুলোতে তারা সাহায্য করবে এবং পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সফল হলে তাদের মাধ্যমে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর জন্য তারা আন্দোলনকারীদের অস্ত্র সরবরাহ করছিল এবং প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ্যাঙ্গোলায় কিউবার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিল, যেটি মূলত হয়েছিল সোভিয়েত অর্থায়নে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সোভিয়েতদের এই আধিপত্যবাদী নীতিকে দক্ষিণ আফ্রিকা মোটেও ভালোভাবে নেয় নি। কারণ, আঞ্চলিক দেশগুলোর উপর দক্ষিণ আফ্রিকার যথেষ্ট প্রভাব বজায় ছিল। আর দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল শুরু থেকেই একটি পুঁজিবাদী দেশ। যেভাবে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকছিল, সেটি আফ্রিকার এই উন্নত দেশটির জন্য মোটেও ভালো বিষয় ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন ভর্সটার তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকাতে হলে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের বিকল্প নেই।
কারণ ছিল আরও। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বর্ণবাদী নীতির কারণে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পাচ্ছিল না। এরকম একটা অবস্থায় যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাত শুরু হয়, তাহলে আমেরিকা কিংবা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে থেকে আপদকালীন সাহায্য পাওয়া যে কঠিন হয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। এজন্য তারা নিজেরাই আপদকালীন সময়ে নিজেদের ভাগ্যবিধাতা হয়ে জনগণকে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারে, সেই পরিকল্পনা থেকেই পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরেনিয়ামের কোন সংকট ছিল না, তাই বোমা বানাতে খুব বেশি ঝামেলা ছিল না তাদের। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে গেলে পরে যদি সেটা ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার একটি বড় সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারপরও ১৯৬৭ সালের দিকে পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। এর বারো বছর পরে, ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম বোমা তৈরি করতে সমর্থ হয়। এই প্রকল্পের সমস্ত তথ্য এতোটাই গোপন রাখা হয়েছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকার মন্ত্রীসভার সমস্ত মন্ত্রীও এটি সম্পর্কে জানতেন না!
দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী এফ. ডব্লিউ ডি ক্লার্ক যখন ১৯৮৯ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে ছয়টি পারমাণবিক বোমা মজুদ ছিল, যেগুলো আমেরিকার দ্বারা নিক্ষেপিত বোমার অনুরূপ শক্তিশালী ছিল। এছাড়া আরও একটি বোমা তৈরির কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালের দিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হতে যাচ্ছে। জার্মানির মাঝে বিভেদের প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো বার্লিন দেয়ালের পতন হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া এ্যাঙ্গোলা থেকেও কিউবার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যেহেতু সোভিয়েতদের হাত থেকে রক্ষার জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল, তাই সোভিয়েতদের পতনের পর বোমা রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা নতুন বোমা তৈরি করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। এছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের জন্য পারমাণবিক বোমা ধ্বংসের আর বিকল্প ছিল না।
১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক বোমার সম্ভার ধ্বংস করে ফেলা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা এই কাজের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লিখিয়ে নেয়। পৃথিবীতে যেখানে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রতি বছর তাদের পারমাণবিক বোমার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে, অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে উদগ্রীব হয়ে আছে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখানোর জন্য, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য, পর্যাপ্ত লোকবল থাকার পরেও স্বেচ্ছায় নিজেদের পারমাণবিক বোমার সম্ভার ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তা নিঃসন্দেহে অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৭
আপনার মতামত জানানঃ