মার্কিন ড্রোন হামলায় কাবুলে নিহত হয়েছে আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি। ২০১১ সালে লাদেন নিহত হওয়ার পর আল কায়েদার প্রধান হয়েছিল জাওয়াহিরি। এখন প্রশ্ন উঠছে, এবার কে হচ্ছেন আল-কায়েদার প্রধান। নাম উঠে এসেছে সইফ আল আদেলের। প্রাক্তন মিসরীয় সেনানায়ক ছিল সইফ আল আদেল। একাধিক সূত্রের মতে, আদেলই হতে চলেছে আল কায়েদার প্রধান। বিবিসির খবর
মিশরে জন্ম নেয়া এই সায়েফ আল-আদেল হচ্ছেন আল-কায়েদার সেই পাঁচজন পুরোনো সদস্যদের একজন, যাদেরকে এক সময় আল-জাওয়াহিরির ডেপুটি হিসেবে দেখা হতো। সেই পাঁচজনের মধ্যে একমাত্র এই আল-আদেলই বেঁচে আছেন।
মনে করা হচ্ছে, তিনিই হয়তো হবেন আল-কায়েদার পরবর্তী নেতা- তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো, আল-আদেল এখন বাস করছেন ইরানে এবং তিনি সেখানে নানা ধরণের বিধি-নিষেধের অধীন।
আল-আদেলকে দেখা হয় একজন রহস্যময় ব্যক্তি হিসেবে। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি, তা ছাড়া ওসামা বিন লাদেনের একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা – এবং জিহাদি আদর্শের একজন সম্মানিত প্রবীণ নেতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে আল-আদেল একজন “পার্সন অব ইন্টারেস্ট” অর্থাৎ যার ওপর তারা নজর রাখে। এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড টেরর লিস্টে তার নাম আছে, এবং তার ব্যাপারে তথ্য দেবার জন্য এক কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছে।
সায়ফ আল-আদেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তানজানিয়া ও কেনিয়ায় ১৯৯৮ সালে মার্কিন দূতাবাসে চালানো দুটি বোমা হামলার সাথে জড়িত ছিলেন – যাতে ২২০ জন নিহত হয়েছিল।
কিন্তু বিভিন্ন রিপোর্টের খবর হলো, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে যে আক্রমণ চালানো হয়, তার বিরোধী ছিলেন এই আল-আদেল।
ওয়েস্ট পয়েন্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি একাডেমির এক দল গবেষক ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক দলিলে এমনটাই দাবি করেছিলেন।
এতে বলা হয়, আল-আদেল ও অন্য আরো কয়েকজন সিনিয়র আল-কায়েদা নেতা আশঙ্কা করেছিলেন যে আমেরিকার মাটিতে বড় আকারের হামলা চালানো হলে আমেরিকার দিক থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া হবে এবং এর অংশ হিসেবে তারা আল-কায়েদার লোকদের নিরাপদ আশ্রয় আফগানিস্তানেও আক্রমণ চালাতে পারে।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বলে দেয়, আল-আদেলের আন্দাজ ছিল নির্ভুল। এ ছাড়াও “নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তথ্য”, যুদ্ধ ও বিপ্লব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখি করেছেন আল-আদেল।
আল-কায়েদায় যোগদানের আগের জীবন
আল-কায়েদায় যোগ দেবার আগে সায়েফ আল-আদেলের জীবন কেমন ছিল – সে সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। এফবিআইয়ের তথ্য মতে – সম্ভবত ১৯৬৩ সালের ১১ই এপ্রিল অথবা তার তিন বছর আগে আল-আদেলের জন্ম।
আল-কায়েদায় তার অবস্থান উচ্চ হলেও তিনি খুব পরিচিত ছিলেন না এবং এই গোষ্ঠীটির প্রচার-প্রচারণাতেও তার উপস্থিতি খুব কমই দেখা যায়। তার আসল নাম নিয়েও সংশয় আছে।
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে যে আক্রমণ চালানো হয়, তার বিরোধী ছিলেন এই আল-আদেল।
মনে করা হয়, সায়েফ আল-আদেল (যার অর্থ ন্যায়বিচারের তরবারি) হয়তো একটি ছদ্মনাম।
অনেকের ধারণা – আল-আদেল আসলে হচ্ছেন মিশরীয় বিশেষ বাহিনীর একজন সাবেক কর্ণেল মোহাম্মদ ইব্রাহিম মাক্কাবি। কিন্তু ওয়েস্ট পয়েন্টের গবেষকরা মনে করেন, এ ধারণা ভুল।
বিভিন্ন দেশে তার তৎপরতা
তিনি উনিশশ’ আশির দশকে আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের পাশাপাশি সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সেটা আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠানের একেবারে প্রথম দিকের কথা।
আল-আদেল এর পর সোমালিয়ায় চলে যান এবং সেখানকার গৃহযুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জঙ্গীদের প্রশিক্ষণে ভুমিকার রাখেন। একটি ঘটনার জন্য ওই যুদ্ধ বিখ্যাত হয়েছিল।
সেটি হলো – এক রকেট হামলায় দুটি আমেরিকান এমএইচ-সিক্স জিরো ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়া। এই ঘটনা নিয়ে পরে ২০০১ সালে একটি ব্লকবাস্টার হলিউড সিনেমা হয়েছিল – যার নাম ব্ল্যাক হক ডাউন।
ধারণা করা হয়, এর মধ্যে একটি রকেট নিক্ষেপ করেছিল আল-আদেলের যোদ্ধাদেরই একজন তিউনিসিয়ান সদস্য। এর পর ১৯৯০এর দশকে আফগানিস্তানে ফিরে আসেন আল-আদেল। সেটা এমন এক সময় যখন তালেবান সারা আফগানিস্তানজুড়ে তাদের দখল সংহত করছে।
এগারোই সেপ্টেম্বরের হামলার পর ২০০১ সালে যখন মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়, তখন আল-আদেলের নেতৃত্বে একদল আল-কায়েদা সদস্য নিরাপদ আশ্রয়ের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরানে চলে যায়।
তবে ধারণা করা হয়, ২০০৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে ইরানী কর্তৃপক্ষ। এর ১২ বছর পর এক বন্দী বিনিময়ের চুক্তির অধীনে আল-আদেল এবং আরো কয়েকজন আল-কায়েদা সদস্য মুক্তি পান। দীর্ঘ সময় অন্তরীণ অবস্থায় থাকলেও আল-কায়েদার ভেতরে একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন আল-আদেল।
আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আমেরিকান বাহিনী ২০১১ সালের মে মাসে – পাকিস্তানের এ্যাবোটাবাদ শহরে এক আক্রমণ চালিয়ে।
এর পর খুব দ্রুতই আল-কায়েদা তাদের নতুন নেতা নির্বাচন করে বিন লাদেনের তার ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচর আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে।
আল-কায়েদার নেতা হিসেবে জাওয়াহিরির অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজেও সহায়তা করেন আল-আদেল।
একজন জ্যেষ্ঠ সন্ত্রাসবাদ দমন বিশ্লেষক সিএনএনকে বলেন, যদি সাইফ আল-আদেলকে শেষ পর্যন্ত জাওয়াহিরির উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, তাহলে ইরানকেও তাঁকে বহিষ্কার করা কিংবা আশ্রয় দেওয়ার মধ্যে একটি বেছে নিতে হবে।
তবে আফগানি নেটওয়ার্কের এক সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, সাইফ আল-আদেল ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের উদ্দেশে ইরান ছেড়েছেন এমনটা শুনেছেন বলে নেটওয়ার্ককে জানিয়েছেন।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, জাওয়াহিরির জামাতা আবদ আল-রহমান আল-মাগরিবিকেও আল-কায়েদার নতুন নেতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। বর্তমানে তিনি সন্ত্রাসী চক্রটির গণমাধ্যম কমিটির নেতৃত্বে আছেন।
আবার আল-কায়েদার নেতৃত্বের দৌড়ে সম্ভাব্য ‘ডার্ক-হর্স’ প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন মিসরীয় অপারেশনাল কমান্ডার আবু ইখলাস আল-মাসরি অথবা আমিন মুহাম্মদ উল হক সাম খান। আইসিসিটির মতে, এর আগে আমিন মুহাম্মদ বিন লাদেনের নিরাপত্তা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৮
আপনার মতামত জানানঃ