১৯৪৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, তখন সারা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে জর্জরিত। সেই সময় রাতের অন্ধকারে কানাডার কোল হার্বার থেকে ১২ জন ব্যক্তিকে নিয়ে ‘কানসো ১১০০৭’ যাত্রা শুরু করে। বিমানটির গন্তব্যস্থল ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপপুঞ্জের ইউক্লুলেট।
বিমান চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে সবাই জানলেও আসলে এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। বিমানের কয়েক জন ক্রু সদস্যের উপর দায়িত্ব ছিল কোল হার্বারে যে বেস ক্যাম্প রয়েছে, সেখানকার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী খুঁজে নিয়ে আসা। এ ছাড়াও সেই বিমানে প্রায় ৪৫৪ কেজি ওজনের বিস্ফোরক ছিল। এই বিমানটি চালানোর দায়িত্বে ছিলেন কানাডার এয়ার ফোর্সের পাইলট অফিসার ক্লারেন্স সার্টোরিয়াস। এর আগেও ইউরোপে ৩০টি ‘সিক্রেট অপারেশন’-এর দায়িত্বভার ছিল তার উপর।
ক্লারেন্স ভেবেছিলেন, ইউক্লুলেটে পৌঁছতে যে সময় লাগবে, তার মাঝে তিনি একটু বিশ্রাম নেবেন। বিমানের বাম দিকে একটি জায়গাও পছন্দ করে ফেললেন বিশ্রামস্থল হিসেবে। কিন্তু তারা কী ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছেন, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ক্লারেন্সের। রাত ১১টা নাগাদ বিমানটি আকাশপথে যাত্রা শুরু করে। তার কিছুক্ষণ পরেই বাম দিকের ইঞ্জিনে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ক্লারেন্স সিদ্ধান্ত নেন, বিমানটি ঘুরিয়ে টোফিনোর বেস ক্যাম্পে নিয়ে যাবেন। এই ভেবে ডান দিকে বিমানটি ঘুরিয়েও ফেলেন তিনি।
ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনার মুখে পড়ে বিমানটি। উঁচু গাছের সারির সঙ্গে বিমানটি ধাক্কা খেতে শুরু করে। কিছু দূর এই ভাবে এগিয়ে যাওয়ার পর বিমানটি আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে থাকে। গতিবেগও কমতে শুরু করে বিমানটির। এই সংঘর্ষের ফলে বিমানের ভেতরের ফুসলেজ থেকে তিনি ছিটকে বেরিয়ে যান এবং একটি গাছের ডালে আটকে পড়েন। মাটি থেকে ১৫ ফুট উপরে ক্লারেন্স ঝুলতে থাকেন। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকার পর তিনি সোজা মাটিতে এসে পড়েন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে কী হয়েছিল, তার কিছুই মনে নেই। এত দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে যে, প্রথম কয়েক সেকেন্ডে কী হয়েছে, তা তিনি বুঝতেই পারেননি। পরে তার হুঁশ ফিরলে তিনি বিমানের দিকে এগিয়ে যান। ক্রুয়ের বাকি সদস্যরা আহত হলেও সবাই বেঁচে রয়েছেন দেখে চিন্তা দূর হয় ক্লারেন্সের। কিন্তু তখনই তাদের নজর পড়ে বিমানের ভেতরে রাখা বিস্ফোরকের উপর। বিমানের ভেতর থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে এসে সেই কাপড় দিয়ে জঙ্গলের মধ্যেই কোনো রকমে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেন সবাই। কয়েক ঘণ্টা এ ভাবেই থাকার পর দূরে কোথাও থেকে তারা অন্য আর একটি বিমানের শব্দ শুনতে পান।
বুঝতে পারেন, তাদের উদ্ধার করতেই লোক আসছে। পরে বিস্ফোরকগুলো সরানো হলেও বিমানটি ঐ ভাবেই একই জায়গায় পড়ে থাকে। এমনকি, সেই বিমান এখনও জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এবং যারা এলাকাটি ভালো করে চেনেন তারা প্রায়ই এখানে হাইকিং করতে যান। তবে, ট্যুরিস্ট স্পট হিসাবে এখনও এই জায়গাটি বেশি জনপ্রিয় নয়। রাডার হিলের রাস্তা দিয়ে আসার সময় টেলিফোন পোল গুনে গুনে নির্দিষ্ট বামকে ঘুরতে হয়। পোল গুনতে ভুল হলেই মুশকিল।
জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট কিছু সাইনবোর্ড রয়েছে। লম্বা লম্বা গাছের সারির মধ্যে দিয়ে কিছু দূর হেঁটে যাওয়ার পরেই সামনে পড়ে একটি ভাঙাচোরা বাড়ি। তার দেওয়ালে পেইন্ট স্প্রে দিয়ে বিভিন্ন গ্রাফিটি চিত্র আঁকা। সেই বাড়ির পিছন দিক দিয়ে উপরে ওঠার রাস্তা রয়েছে। তবে, রাস্তাটি কর্দমাক্ত। এমনকি, তীব্র গরমেও এখানে কাদা জমে থাকে। কাদাজমা রাস্তা পার করলেই একটি পুকুর। আর সেই পুকুরের পাশেই রয়েছে বিমানের ভগ্নাবশেষ।
ক্লারেন্স এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, সেই রাতে তাদের সবার উদ্ধার করার পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চার থেকে পাঁচ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা চলার পর আবার অন্য একটি ক্যাসনো বিমানে তাদের কোল হার্বারে ফিরিয়ে আনা হয়। এই বিমানের সব ক্রু সদস্য আগে নানা সময় মারা গেলেও ক্লারেন্স ৯১ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন।
তিনি জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার ৭০ বছর কেটে যাওয়ার পরেও তিনি কখনো আর রাডার হিলের জঙ্গলের ভেতর যাননি। তবে যে এলাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সঙ্গে যুক্ত, তাকে এখনও পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের তরফে জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে সংবাদ সূত্রের খবর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ