রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মজুড়ে দেওয়া। শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক পথে না থাকা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার না হওয়া। সাম্প্রদায়িক হামলার অপরাধীদের বাইরে রেখে নির্যাতিতদের জেলে রাখার কারণে দেশে নড়াইলের মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজও সঠিক ভূমিকা পালন না করে নীরবতা পালন করছে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ সব জায়গার নীরবতার ফলে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বাড়ছে। দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদই এ সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ।
রোববার ‘সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নাগরিক প্রতিবাদ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
বক্তারা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের আসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে জন্ম নেয়া এই দেশে এ ধরনের সহিংসতামূলক ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি লজ্জাজনক। এগুলো সবই রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল মাত্র।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে দেশের বিশিষ্টজন বক্তব্য দেন। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও চিন্তক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে যেসব সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে, তার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চেহারা সাম্প্রদায়িক, কিন্তু চরিত্র রাজনৈতিক। এর সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত।
তিনি বলেন, নড়াইলে যে আক্রমণ হলো, সেখানে আওয়াজ ও ধ্বনি তোলা হয়েছে, সেগুলো পরিচিত। এ ঘটনা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে ৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪ জন শাসক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। এই রাষ্ট্র মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না, মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে রেখেছে এগুলো সব সত্য। সাম্প্রদায়িক হামলার নৃশংস ঘটনাগুলোতে প্রশাসন তৎপর হচ্ছে না বলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত যেতে পারছে না।
আরও বলেন, বর্বরোচিত ঘন্টার পর বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকেরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন না দুটি কারণে। একটি হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো কথা বললে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পড়ে যাবেন, জামিন পাবেন না। আরেকটা আছে, প্রলোভন। এত সুবিধা তৈরি হয়েছে দেশে গত ৫০ বছরে। সেই সুবিধাগুলোর যে লোলুপতা, তা বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বত্র লোলুপতার রাজত্ব চলছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নড়াইলে যে আক্রমণ হলো, সেখানে আওয়াজ ও ধ্বনি তোলা হয়েছে, সেগুলো পরিচিত। সেগুলো ব্রিটিশ আমলে শুনেছি, তখন ব্রিটিশ রাষ্ট্র তা প্রশ্রয় দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে ওই আওয়াজ শুনেছি, পাকিস্তান রাষ্ট্র সেগুলো উৎসাহিত করেছে। আজকের বাংলাদেশে ওই আওয়াজগুলো শুনতে হলো। এর অর্থ হলো, রাষ্ট্র চেহারায় বদলেছে, ছোট হয়েছে বড় রাষ্ট্র, কিন্তু চরিত্রে রাষ্ট্রের কোন বদল হয়নি। এটা হচ্ছে নির্মম সত্য।’
দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করছেন, তারা ধর্মীয় গোষ্ঠী নাকি কোন দলের সুবিধাবাদী লোক, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করছেন, তারা ধর্মীয় গোষ্ঠী নাকি কোন দলের সুবিধাবাদী লোক, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকলে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করা যাবে না।’
সেন্টার ফর পলসি ডায়লগের (সিডিপি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত অক্টোবরে এরকম একটি প্রতিবাদ সভার কিছুদিনের মধ্যইে যে আবারো এ ধরনের আরকেটি সভার আয়োজন করতে হচ্ছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর যে সহিংসতামূলক হামলা করা হয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা এই নাগরিক প্রতিবাদ সভার অন্যতম উদ্দেশ।’
পল্লী র্কম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জামান আলাচনা সভার সভাপতিত্ব করনে। তিনি মনে করেন, ‘সংখ্যালঘু বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। সবাই মানুষ, সবাই বাংলাদেশি- এটাই স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সবাইকে আমরা সম-অধিকার, সম-মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখি যেখানে কোন র্ধমীয় বা সাম্প্রদায়িক ব্যবধান নেই। সাম্প্রতিকালে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো উদ্বেগজনক এবং অনেক বেশি গুরুত্বর্পূণ।
তিনি আরও বলেন, অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নাকি বাড়িয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা তো কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করেননি! বরং, এ ঘটনায় তাদের হৃদয়ের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার দায়ভার কে নিবে? এ প্রশ্ন করেন হ্যামলেট সাহা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মজি শাহীন আনাম বলেন, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটইি অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য অপমানজনক। নাগরকি সমাজের অবশ্যই এক্ষেত্রে একটা দায়িত্ব রয়েছে। যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার পর পুলিশ আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ ধরনের পরস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার আগেই এর বিরুদ্ধে যেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে আমরা সম্পদ না বাঁচিয়ে সম্মান বাঁচাই। আমাদের নির্লিপ্ত থাকাও অনেকাংশে দায়ী র্বতমান এই পরস্থিতির জন্য। অনুষ্ঠানে আরও অনেক বিশিষ্ট নাগরিক উপস্থিত থেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, এই রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক নয়, এটা স্বীকার করতে হবে। গতবছর দুর্গাপূজায় হামলার বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অস্বীকার করেন এবং তা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার। হামলাকারীদের না ধরে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে হামলার শিকার মানুষদের জেলে নেওয়া হয়। আমাদের এসবের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
কাজল দেবনাথ বলেন, এর আগের সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হামলাকারীরা কয়েকদিন ধরে পরিকল্পনা করে হামলা করেছে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিল। সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে শিক্ষক লাঞ্ছনা। এসময় তিনি এসব হামলা ও লাঞ্ছনার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, সংখ্যালঘু বলে কোনো কিছু এ দেশের সংবিধানে নেই। এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে নাগরিক সমাজকে সচেতন এবং সক্রিয় হতে হবে। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।
সারওয়ার আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, সেই পথ থেকে বাংলাদেশ সরে যাচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যাগুলো সমাজের মানুষের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ফলে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজও শক্তিশালী প্রতিবাদ করছে না। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সমবেতভাবে সাংস্কৃতিক চর্চার পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৪৮
আপনার মতামত জানানঃ